© অরুণ আনন্দ
ধর্মীয় চরমপন্থা, যা এখন এক বৈশ্বিক আবৃত্তির আকার নিয়েছে, তা বাংলাদেশে নতুন নয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের প্রধান নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা-কে মুছে ফেলার
জন্যে ধর্মীয় চরমপন্থী দলগুলির প্রচেষ্টার সম্মুখীনে আছে বাংলাদেশ। এর এক পরিণীতি ঢাকার
রাজনীতিতে দেখা যায়–রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং মৌলবাদী ইসলামপন্থীদের মধ্যে
টানাপোড়া–যা আজ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের মূল ধারণার এক ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ। মৌলবাদী
ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো এবং তাদের সন্ত্রাসের যোগসূত্রের এক নজর এটি স্পষ্ট করে তুলবে।
১৯৪১ সালে হায়দ্রাবাদে (বর্তমান ভারত) আব্দুল আ’আলা মওদুদী প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের
বৃহত্তম ইসলামী রাজনৈতিক দল–জামায়াতে ইসলামী (জেইআই)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হওয়ার জন্য
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জেইআইকে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ১৯৭৬ সালে জিয়া সরকারের
শাসনামলে সময় জেইআই-এর, যা এখন বাংলাদেশ (জেইআইবি) নামে পরিচিত, ওপর থেকে
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে যা ধর্মভিত্তিক
রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতির পর থেকে জেআইবি’র রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়। তারা
বাংলাদেশে একটি ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তব করতে নিয়োজিত
থাকে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগ উভয়ের সাথে জোটবদ্ধ
হয়েছে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে।
নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ পার্টির দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭৩ ইন্টারনেশনাল
ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) অ্যাক্ট লাগু করা হয় ২০০৯ সালে পরিবর্তন এবং সংশোধন
সমেত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতন
অপরাধে শাস্তির প্রদানের জন্য। এরপর ১৯৭০-এর শুরুর দশকের শীর্ষ জেইআই সদস্যদের
কোর্টে বিচার ও শাস্তি এবং জেইআই-এর রাজনৈতিক দল হিসাবে রেজিস্ট্রেশন ২০১৩ সালে হাই
কোর্টের আদেশে বাতিলের পর তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা গুরুতর চোট পায়। এর ছাত্র সংগঠন
ইসলামী ছাত্রশিবির (আইসিএস), যা শিক্ষা ব্যবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় অতন্ত
প্রভাবশালী, তার পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইসিএস) সাথে ঘনিষ্ট
সম্পর্ক আছে বলে জানা যায়। এই ছাত্র সংগঠনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যা তারা “অ-
ইসলামিক” বলে মনে করে তাতে সহিংস কর্মকান্ডের জন্য কুখ্যাত এবং সম্প্রতি আওয়ামী লীগ
সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্যাডারদের উগ্রপন্থী করার সাথে জড়িত।
তালেবান এবং ইসলামী খিলাফতের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৮০-১৯৯০ এর দশকে মুসলিম
মিল্লাত বাহিনী (এমএমবি), হিজবুত তাহরির (এইচটি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ
(হুজিবি), হিজবুত তৌহিদ (এইচইউটি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাত-উল-
মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর মতো চরমপন্থী দলগুলি জন্ম নায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আফগান জিহাদে যোগ দেওয়া যোদ্ধাদের (এবং তাদের
অনুসারীদের) দ্বারা। এই মৌলবাদী ইসলামী সংগঠনগুলোর মধ্যে একই লক্ষ্য– বাংলাদেশে
ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ
(জেএমবি), যা ১৯৮৮ সালে গঠন হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মতাদর্শ সালাফি মতবাদ ও
ইসলামের হ্রাসবাদী ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে যা গণতন্ত্র বিরোধী, যা শরিয়াকে কঠোরভাবে
প্রয়োগ করতে চায় একমাত্র আইনশাসন হিসেবে প্রয়োগ করতে চায়। ধারণা করা হয় যে
জেএমবির সঙ্গে আল-মুজাহিদীনের যোগাযোগ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো
জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি)। ২০০৫ সালে এনজিও এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানে ন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং সহিংসতা প্রচারণায় যেমন বোমা হামলা, আইনজীবী,
সাংবাদিক, পুলিশ, সরকারী ব্যক্তিত্ব, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং নিরপরাধ নাগরিকদের ওপর
আক্রমণে জড়িত থাকার জন্য বাংলাদেশ সরকার জেএমবিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে
নিষিদ্ধ করে। ২০০৭ সালে জেএমবি ও জেএমজেবির প্রধান মাওলানা আবদুর রহমান-সহ অন্যান্য
নেতাদের ঢাকায় দুই বিচারককে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়।
পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবার (এলইটি) সাথে জেএমবির সম্পর্ক রয়েছে বলে
জানা গেছে, যার মাধ্যমে জেএমবি সদস্যরা পাকিস্তানে লস্কর-ই-তৈবার কাছ থেকে ট্রেনিং
নিয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং কুয়েত, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, বাহরাইনে কাজ করা জেএমবি
সহানুভূতিশীলদের কাছ থেকে তহবিল পেয়েছিল। পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং লিবিয়া-র পাশাপাশি
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক এনজিও তহবিল দিয়ে জেইআই, জেএমবিকে সাহায্য করেছে।
এই উল্লিখিত বেশিরভাগ উগ্রইসলামী সংগঠনগুলি ২০০৭ সালের মধ্যে কঠোর মিলিটারি
ক্র্যাকডাউন মুখোমুখি হয়েছিল, যার কারণে সন্ত্রাসী হামলার তীব্রতা অনেকটা কমেছিল এবং
২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশটিতে নীরবতা বজায় থাকে।
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে এক নতুন করেসহিংস সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয়, যা স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস হামলা হিসেবে
মনে করা হয়। ২০০৭ সালে গঠিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) যা ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার (একিউআইএস) সহযোগী বলে মনে করা হয়, ২০১৩-২০১৬ সালে ধারাবাহিক সন্ত্রাসীহামলার জন্য কুখ্যাত হয় ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত। ২০১৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার
আহমদ রাজীব হায়দারের হত্যার থেকে শুরু হয় সহিংস সন্ত্রাসী হামলা, ধর্মনিরপেক্ষ/অধর্মীয়
ব্লগার, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্টদেড় লক্ষ্য করে। নিষিদ্ধ হওয়ার পরে,
এবিটি মূলত অনলাইনে তাদের কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে চালু করে, আক্রমণ চালানোর জন্য তার
সমর্থকদের মগজধোলাই করে বলে জানা যায়। ২০০৯ সালে সরকারের নারী উন্নয়ন নীতির ড্রাফট
যা নারীদের উত্তরাধিকারসূত্রে সমান অধিকার দায়ে, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জুড়ে ২৫,০০০ এরও
বেশি মাদ্রাসার সমন্বয়ে গঠিত একটি মৌলবাদী ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম (এইচইআই)
তৈরী হয়। ২০১৩ সালের শাহবাগ ক্যাম্পেইনের সক্রিয় সদস্য আহমদ রাজীব হায়দারের হত্যার
পর, এইচইআই একটি রেলি বার করে যেখানে তারা সরকারের কাছে তাদের ১৩ দফা দাবি
উপস্থাপন করে, যেমন, ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদণ্ড, আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা,
বৈদেশিক ও অ-ইসলামিক সাংস্কৃতিক প্রভাবের নিন্দা, জনসম্মুখে কঠোর লিঙ্গ বিভাজন। ঢাকায়
অবস্থিত অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনের বিপরীতে, এইচইআই চট্টগ্রাম থেকে তার কার্যক্রম
পরিচালনা করেছিল, আহমদ শফী-র সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। জেইআই-এর পতন বাংলাদেশের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ মৌলবাদী সংগঠন হিসাবে এইচইআইয়ের খ্যাতির কারণ বলে মনে করা হয়। তবে
২০১৬ সালের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে বাংলাদেশী জঙ্গিহামলা যার ফলে ২২ জনের হত্যা হয়,
যাদের বেশিরভাগই বিদেশি, তা দেশকে কাঁপিয়ে দায়ে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায়
স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ সরকার বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গি
গোষ্ঠীগুলোর যোগসূত্র অস্বীকার করেছে এবং মূলত তাদের ‘নব্য জেএমবি’ বলে অভিযুক্ত
করেছে।
২০১৩ জঙ্গিহামলার ধরণ দেখলে করে একটা স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
আক্রমণকারীরা বেশিরভাগই শিক্ষিত (এমনকি বৈদেশিক শিক্ষিত), আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবার
থেকে আসা । এতে বোঝা যায় যে শহুরে, শিক্ষিত, অভিজাত যুবদের উগ্র ইসলামী মতাদর্শের প্রতি
আকর্ষিত হয়েছে। জনসংখ্যার এই নতুন অংশকে আকৃষ্ট করার পিছনে আছে ‘প্রযুক্তি-সচেতন’
ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলি সাইবার মৌলবাদের সফল ব্যবহার। অবৈধিক ‘হুন্ডি’ ব্যবস্থার
মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা অর্থ (রেমিট্যান্স ট্যাক্স) মূলতেই এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির
অর্থায়নের করে বলে মনে করা হয়। হুন্ডি ছাড়াও, অপরাধমূলক কার্যকলাপ, বৈধ ব্যবসা এবং
স্ব-তহবিলের (গোষ্ঠীর সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা) মাধ্যমে, ননপ্রফিট ও শিল্পপতিদের
থেকে অনুদানে এই সন্ত্রাসী তহবিলে অবদান আছে যা দমন করা কঠিন ।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ
নিয়েছে। ২০০৯ সালে আন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট “নির্দিষ্ট সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং
তার শাস্তির” লাগু করা হয় এবং পরবর্তীতে এতে ২০১২-এর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ
আইন,পারস্পরিক আইনি সহায়তা আইন, এবং ২০১৩ সন্ত্রাসবিরোধী সংশোধনী আইন দেশের
ভিতর এবং বাইরে যে কারও দ্বারা সন্ত্রাসী সংগঠনের অর্থায়ন প্রতিরোধের বিধান যোগ করা
হয়। এছাড়া সরকার ২০১৫ সালে ৬০০ সদস্যের একটি পুলিশ ইউনিট সিটিটিসিইউ (কাউন্টার
টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) প্রতিষ্ঠা করেছে স ন্ত্রাসবাদ, সাইবার
ক্রাইম, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং মোবাইল ব্যাংকিং সম্পর্কিত অপরাধ দমন করতে। ২০০৪
সাল থেকে সক্রিয় বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট রেপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন
সহিংস সন্ত্রাসী কার্যক্রম যা দেশে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে তা রুখতে সন্ত্রাসী
সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বছরের গ্লোবাল
টেরোরিজম ইনডেক্স -এ ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩তম, যা দেশে সন্ত্রাসবাদ
মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের সাফল্যের ইঙ্গিত।
তবে বাংলাদেশ মৌলবাদী ইসলামি প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়। সম্প্রতি ঢাকার একটি
হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর দৃশ্য, যেখানে বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর
সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তা চিন্তার
বিষয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অমানবিক অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে দেলোয়ার হোসেন
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তির প্রতি সমর্থনের দৃশ্য দেখে
বোঝা যায় যে দেশে উগ্র ইসলামপন্থী প্রভাব এখনো রয়েছে। এটি শুধু মাত্র বাংলাদেশের
জাতীয়তাবাদ-ই নয় , আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি যাওয়া আওয়ামী লীগ
সরকারের জন্যও একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।