© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
অষ্টসিদ্ধির কথা আমরা বিভিন্ন সনাতন শাস্ত্র ও সাহিত্য গ্রন্থে পেয়ে থাকি। সংস্কৃত ভাষায় অষ্ট শব্দের অর্থ আট , আর সিদ্ধি হল জ্ঞান। অষ্টসিদ্ধি বলতে বোঝায় আট প্রকার দৈবজ্ঞান যা অর্জন করতে পারলে কোন সাধক প্রত্যেক বিষয়ে পরম জ্ঞান লাভ করতে পারেন। আমরা জানি গণপতিকে সিদ্ধিদাতা বলে অভিহিত করা হয় এবং গণপতি ভজনার সময় এই অষ্টসিদ্ধির উল্লেখ করা হয়। আবার ভক্ত তুলসীদাস বিরোচিত হনুমান চল্লিশার একত্রিশ ও বত্রিশতম চৌপাঈতে লেখা হয়েছে :
অষ্ঠসিদ্ধি নব নিধি কে দাতা । অস বর দীন্হ জানকী মাতা ॥ রাম রসাযন তুম্হারে পাসা । সদা রহো রঘুপতি কে দাসা ॥
এর অর্থ এই যে হনুমান শুধুমাত্র আটটিসিদ্ধি প্রাপ্ত করেছিলেন তাই নয় , তিনি নয়টি নিধিও প্রাপ্ত করেছিলেন। রুদ্রের অবতার হবার জন্য হনুমান আজন্ম অষ্টসিদ্ধি ও নয় নিধি প্রাপ্তবান ছিলেন। সীতা দেবী তাঁকে আশীর্বাদ করে অষ্টসিদ্ধি ও নয়টি নিধি প্রদানের ক্ষমতা দেন। উল্লেখ্য সীতা দেবীকে অন্বেষণ করতে হনুমান যখন লঙ্কা পৌঁছন, তখন তিনি শত্রু শিবিরে প্রবেশ করবার জন্য অনিমা নামক সিদ্ধির প্রয়োগ করেন। তিনি যখন সীতা সমীপে পৌঁছন, তখন তিনি আবার অনিমা শক্তির প্রয়োগ করে সূক্ষ্ম রূপ ধারণ করেন যাতে সীতা -মাতা তাঁকে দেখে ভয় না পান। আবার মহিমা নামক আরেক সিদ্ধি প্রয়োগ করে হনুমান রাক্ষসদের বোকা বানান এবং রাক্ষসৈন্যদের যুদ্ধে পরাজিত করেন। হনুমান গরিমা নামক সিদ্ধিরও প্রয়োগ করেন যখন তিনি লঙ্কেশ রাবণের সম্মুখে আসার জন্য স্বেচ্ছায় মেঘনাদের হাতে ধরা দেন। বন্দী হয়ে রাবণের রাজসভায় এসে গরিমা নামক সিদ্ধি প্রয়োগের উদ্দেশ্য ছিল পরম শক্তিশালী রাক্ষসরাজ রাবণকে রামচন্দ্রের সেবকের শক্তির প্রদর্শন করানো : রাবণের মনে ভীতির উদ্রেক করানো: তাঁকে ভাবানো যে প্রভু শ্রীরামের দাসের শক্তি যদি এত হয় , তাহলে স্বয়ং প্রভুর শক্তি কি রূপ হতে পারে। মহিমা সিদ্ধির প্রয়োগ তিনি এমনভাবে করেন যে পরমবীর রাক্ষসরাজ রাবণ হনুমানের লেজ উত্তালিত করতে ব্যর্থ হন।
অষ্টসিদ্ধি বলতে যে আটটি সিদ্ধির কথা বোঝানো হয় সেগুলি হল অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা , প্রাপ্তি, প্রকম্য, ঈশিত্ব ও বশিত্ব। প্রত্যেক সিদ্ধি প্রকৃতি বা চরিত্রের কিছু কিছু গুণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং যে সাধক এই আটটি সিদ্ধি আয়ত্ত করতে পেরেছেন, তিনি অষ্ট সিদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সকল গুণের অধিকারী হতে পারেন। নীচে আট প্রকার সিদ্ধি আলোচিত হল।
অনিমা
অনিমা হল অষ্টসিদ্ধির মধ্যে প্রথম। এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে একজন সাধক তাঁর নিজের দেহকে ইচ্ছামত সংকুচিত করার ক্ষমতা লাভ করেন। তবে অনিমা শুধুমাত্র দেহকে সংকুচিত করার ক্ষমতা প্রদান করে। এর দ্বারা দেহের আকৃতি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধি প্রাপ্তবান হলে সাধক নিজের দেহকে ইচ্ছামত ক্ষুদ্র করতে এমনকি পরমাণু সদৃশ করতেও সক্ষম হন। এই সিদ্ধির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায় রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডে যেখানে সীতা মাতাকে অনুসন্ধানের জন্য হনুমান লঙ্কা প্রবেশ করেন। এই সময় যখন সীতা মাতার খোঁজে হনুমান লঙ্কার এদিক ওদিক ঘুরছেন, তখন তিনি অনিমার প্রয়োগ ঘটিয়ে দেহকে এতটাই সূক্ষ্ম করে ফেলেন যে লঙ্কার রাক্ষস প্রহরীরা তাঁকে দেখতে পাননি।
মহিমা
মহিমা হল এমন একটি সিদ্ধি যা একজন সাধকের দৈহিক আকৃতিকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এই সিদ্ধির প্রাপ্তি না করলে অনিমা সিদ্ধির প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয় না কারণ অনিমা শুধুমাত্র দেহকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। আর মহিমার প্রয়োগ করে সংকুচিত দেহ পুনরায় বিরাট করা সম্ভব হয়। রামায়ণের লঙ্কা কাণ্ডে লক্ষণ রাবণ নিক্ষেপিত শক্তিশেলে মূর্ছা গেলে হনুমান মহিমার প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজেকে বিরাটকায় করেছিলেন সঞ্জীবনী বুটি সহ সুমেরু পর্বতকে নিয়ে আসার জন্য। লক্ষণের জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি এই সিদ্ধির প্রয়োগ ঘটান। হিন্দু শাস্ত্রে মহিমা প্রয়োগের আরেকটি নিদর্শন পাওয়া যায় ভগবান বিষ্ণুর বামন অবতারের বর্ণনায়। রাক্ষসরাজ বলির দর্প নিরসনের জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন রূপ গ্রহণ করেন। রাক্ষসরাজ বলি যখন বামনকে ত্রিপাদ জমি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, তখন বামন অবতার মহিমা প্রয়োগ করে বিশাল আকার ধারণ করেন এবং স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তাঁর তিন পদের দ্বারা দখল করে নেন।
গরিমা
গরিমা সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধক শরীরের ওজন পরিবর্তনে সক্ষম করে। অনিমা যেমন একজন সাধককে নিজের দেহকে সূক্ষ্ম করতে সাহায্য করে, সেরকম গরিমার প্রয়োগ করে একজন সাধক নিজের দেহের ওজন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। এই সিদ্ধির দ্বারা সাধক দেহের ওজনকে স্বল্প থেকে অনেক ভারি করতে পারেন। দেহ এই সময় এতটাই ভারী হয়ে যায় যে শরীরকে অথবা শরীরের কোন অঙ্গকে আর নাড়ানো বা সরানো সম্ভব হয় না। শ্রীরামের সেনাপতি তথা কিষ্কিন্ধ্যার যুবরাজ অঙ্গদ যখন রামের দূত হয়ে রাবণের রাজসভায় আসেন, তখন তিনি তাঁর পদকে এমন ভাবে রাখেন যে রাবণের কোন সভাসদ তাঁর সেই পদকে সরাতে ব্যর্থ হন। এই সময়ে অঙ্গদ গরিমা প্রয়োগ করেছিলেন। গরিমা প্রয়োগের আরেকটি নিদর্শন পাওয়া যায় মহাভারতে। ভীমের শক্তির অহংকার নিরসনের জন্য হনুমান একটি বৃদ্ধ বানরের রূপ ধরে ভীমের যাবার পথ আটকে শুয়েছিলেন। ভীম তাঁর সম্মুখে এলে হনুমান ভীমকে তাঁর লেজ তুলে চলে যেতে বলেন, কিন্তু মহা শক্তিধর ভীম ওই লেজ তুলতে ব্যর্থ হন। এই সময়ে হনুমান গরিমা প্রয়োগ করেছিলেন।
লঘিমা
লঘিমা হল গরিমার ঠিক বিপরীত সিদ্ধি। গরিমা ও লঘিমার সম্পর্ক অনেকটা অনিমা ও মহিমার সম্পর্কের মতোই বিপরীতমুখী। লঘিমা সাধকের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক তাঁর ওজন শরীরের ওজন এতটাই হাল্কা করে নিতে পারেন যে তিনি আকাশে উড়তে পর্যন্ত সমর্থ হন। হনুমান এই সিদ্ধির প্রয়োগ করেই সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। হনুমান ছাড়াও অন্যান্য দেবগন ও রাক্ষসেরা এই সিদ্ধির প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন।
প্রাপ্তি
পূর্বের চারটি সিদ্ধির থেকে প্রাপ্তি পুরোপুরি পৃথক। অনিমা, মহিমা, গরিমা বা লঘিমা দেহের আকৃতি বা ওজনের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু প্রাপ্তি এগুলির সদৃশ নয়। প্রাপ্তি প্রয়োগ করে সাধক তাঁর ইচ্ছামত কোন বস্তু তৎক্ষণাৎ লাভ করতে পারেন । এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক শূন্য থেকেই তাঁর আকাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভ করতে পারেন। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র পাঠ করলে আমরা অনেক দেব- দেবী রাক্ষস বা দানবকে দেখতে পাই যাঁরা এই সিদ্ধি প্রয়োগে দক্ষ ছিলেন, যেমন দেবতাদের আমরা দেখি শূন্য থেকে কোন বস্তু প্রাপ্ত করে বর রূপে ভক্তকে দিতে। আবার রাক্ষসেরা শূন্য থেকে শস্ত্র প্রাপ্তি করতেন।
প্রকম্য
প্রকম্য এমন একপ্রকার সিদ্ধি যা সাধককে জীবনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক মুহূর্তের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে নিজের ইচ্ছামত অন্যকোন স্থানে গমন করতে ও জলের নিচে বেঁচে থাকতে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষে প্রকম্য সিদ্ধির
প্রয়োগ সাধককে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে তোলে। হিন্দু শাস্ত্রে বহু ঋষি – মুনি, দেব – দেবী , রাক্ষস এবং চিরঞ্জীবীদের উল্লেখ আছে যাঁরা এই সিদ্ধি আয়ত্ত করে জলের তলায় জীবন নির্বাহ করতে বা নিজেদের জীবনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম ছিলেন।
ঈশিতা
ঈশিতা সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা সাধক প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যখন কোন সাধক এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হন, তখন তিনি তাঁর ইচ্ছামত পৃথিবীকে আবর্তিত করতে বা বৃষ্টি আনতে পারেন। ঈশিতা প্রয়োগের দ্বারা প্রকৃতির প্রত্যেক ঘটনা সাধকের ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। হিন্দু শাস্ত্রে আমরা অনেক দেব – দেবীকে দেখতে পাই যাঁরা এই সিদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে কোন বৃক্ষের বৃদ্ধি ঘটাতে পারতেন বা বৃষ্টি নামাতে পারতেন।
বশিতা
অষ্টসিদ্ধির অন্তিম সিদ্ধি হল বশিতা যার প্রয়োগের দ্বারা সাধক অন্যের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন । এই সিদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা মানুষ ছাড়াও মনুষ্যতর জীবেরও মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই এই সিদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে বন্য জানোয়ার এবং মানসিক ভারসাম্যহীনদের মনকে বশ মানানো সম্ভব । ভগবান বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের দ্বারা এই সিদ্ধির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা বশিতা প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রুদ্ধ জানোয়ার বা মানুষকে শান্ত করেছেন।
সনাতন শাস্ত্র, সাহিত্য বা পুরাণে আমরা বহু দেব -দেবী , অবতার, রাক্ষস এবং আটজন চিরঞ্জীবীকে অষ্ট সিদ্ধির প্রয়োগ করতে দেখি ,তবে আটটি সিদ্ধির সবগুলিই তাঁদের সবার আয়ত্তে ছিল না। একমাত্র গণপতি এবং হনুমান এই আটটি সিদ্ধিকে নিজেদের আয়ত্তে এনেছিলেন।