© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
বিগত ফেব্রুয়ারী মাসে উত্তর পূর্ব ভারতের তিন রাজ্য ত্রিপুরা, মেঘালয় আর নাগাল্যান্ডে যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার ফলাফল প্রকাশিত হল ২ মার্চ, ২০২৩। এই তিন রাজ্যের রাজ্য সরকার বাছাইয়ের নির্বাচনে মতদানের পার্সেন্টেজ ছিল এইরকম – ত্রিপুরা ৯০ শতাংশ, নাগাল্যান্ড : ৮২.২৭ শতাংশ, মেঘালয় ৮৫.২৫ শতাংশ। মতদানের এই উচ্চ হার বুঝিয়ে দেয় বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে উত্তর পূর্বের মানুষের আগ্রহ।
মনে রাখতে হবে একটা সময় ছিল যখন উত্তরপূর্বের মানুষ মূল ভারত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বলে মনে করত ; ছিল বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এবং ভোট বয়কটের ডাক। ২০১৪ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী হলেন শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর একটি স্লোগান ছিল ‘Look East’। অর্থাৎ পূর্ব ভারতকে নিয়ে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী ছিলেন তিনি। এই পরিকল্পনার একটি অঙ্গ হল উত্তর-পূর্ব ভারতকে ভারতের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া। এরপর উত্তরপূর্ব ভারতে চলেছে
একের পর এক উন্নয়ন যজ্ঞ। এখানকার রাজ্যগুলিতে সেতু, রাস্তা গঠন করা হয়েছে, শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে, ভারতীয় রেলপথের মানচিত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতকে নিয়ে আসা হয়েছে কেন্দ্র সরকারের উদ্যোগে।
এছাড়াও এখানকার জনজাতিদের মধ্যে সনাতন ভারতীয় ভাবধারা , স্বদেশপ্রেম নিয়ে আসার যে সফল প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তারই ফলাফল হল বিধানসভার নির্বাচনে এই স্বতঃস্ফূর্ত মতদান। এই মতদান প্রমাণ করে সামাজিক, আর্থিক, আত্মিক সকল দিক থেকে উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি আজ অখণ্ড ভারতের অংশ হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য মোদী সরকারের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ( আইন ও বিচার মন্ত্রী ) এই উত্তর পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদ। তবে এই রাজ্যগুলিকে মূল ভারতের সঙ্গে আত্মিক ভাবে যুক্ত করা একটি দীর্ঘমেয়াদী ও ধারাবাহিক কাজ। বর্তমানে সংঘ পরিবার সেই কাজটি করে চলেছে। এবারে আসা যাক ২০২৩ সালে এই অঞ্চলের তিনটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কিত আলোচনায়।
ত্রিপুরাতে পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে সবাইকে অবাক করে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। এর আগে এই রাজ্য ১৯৯৩ থেকে টানা ২৫ বছর কমিউনিস্ট শাসনাধীন ছিল এবং বিজেপির কোন সদস্য কোনদিন এই বিধানসভায় ছিল না। আর এস এসের নিষ্ঠাবান কার্যকর্তাদের কাজের ওপর ভিত্তি করেই এই অসাধ্য সাধিত হয়, ক্ষমতায় আসে রাষ্ট্রবাদী শক্তি। ২০২৩ সালেও ৬০টি আসনের মধ্যে ৩৩টি আসন পেয়ে ত্রিপুরায় ক্ষমতা বজায় রাখল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ জোট। কিন্তু গতবারের থেকে কমল ভোট এবং আসন। বিজেপির উপ মুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মন পরাজিত হলেন : জোট সঙ্গী জনজাতিদের দল আই পি টি এফ এর আসনসংখ্যা ৮থেকে কমে হল ১। কারণ হলো প্রদ্যোৎ মানিক্য দেববর্মনের নেতৃত্বে তিপ্রামোথা দলের উত্থান। উল্লেখ্য এই প্রদ্যোৎ দেব বর্মন হলেন রাজপরিবারের সদস্য এবং জিষ্ণু দেব বর্মনের আত্মীয়। এতদিন বিজেপির সঙ্গে থাকার পর ঠিক নির্বাচনের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে তিনি লড়াই শুরু করলেন, চাইলেন আলাদা রাজ্য। যাই হোক ক্ষমতায় না আসতে পারলেও ক্ষতি হলো এন ডি এ জোটের । আগামী দিনে ১৩টি আসন নিয়ে তিনি বসবেন বিরোধী বেঞ্চে। রাষ্ট্রবাদী শক্তির উচিত যত দ্রুত সম্ভব কূটনীতির দ্বারা এই সমস্যা দুর করা, নাহলে আগামী দিনে বিপদ আসন্ন। আশার কথা এই যে তিপ্রামোথা ঘোষণা করেছে যে হিন্দু বিরোধী কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেসের সঙ্গে এই দল জোট করছে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ত্রিপুরা বিধানসভার শুরুর সময় থেকে ( ১৯৬৭) কমিউনিস্ট এবং কংগ্রেস ছিল যুযুধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু বিজেপির আগমনে এই দুই শক্তি এখন একত্রিত এবং এইবারের বিধানসভায় উভয়ে মিলে আসন পেয়েছে ১৪টি ( কমিউনিস্ট : ১১, কংগ্রেস : ০৩ )। এখন এই তথাকথিত সেকুলার হিন্দু বিরোধী শক্তি পাশে চাইবে তিপ্রামোথাকে আর রাষ্ট্রবাদীদের কাজ হবে তিপ্রামোথাকে এদের সঙ্গে একত্রিত না হতে দেওয়া।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত নাগাল্যান্ডের ফলাফল রাষ্ট্রবাদীদের কাছে যথেষ্ট সন্তোষজনক। এখানে ৬০টি আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন এন ডি এ জিতেছে ৩৭টি আসনে। এর মধ্যে নেফিউ রিওর দল ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি জিতেছে ২৫টি আসন আর বিজেপি ১২টি । অর্থাৎ বিজেপির সাহায্য বিনা সরকার চলবে না। এটি বিজেপির কাছে ভাল অবস্থা। নাগাল্যান্ড বিধানসভায় একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হল কংগ্রেসের সদস্য শূন্য হয়ে যাওয়া। এইবারের নির্বাচনে একটি আসনও জিততে ব্যর্থ কংগ্রেস। এটিও স্বস্তিদায়ক। ৭টি আসন পেয়ে এবারে প্রধান বিরোধী দল হচ্ছে এন সি পি। অন্যান্য যে সব দল বিধানসভায় যাচ্ছে তারা হল কনরাড সংমার এন পি পি ( ৫), লোক জন শক্তি পার্টি ( ২), নাগা পিপলস ফ্রন্ট (২ ), রিপাবলিকান পার্টি (২ ) , জনতা দল ইউনাইটেড (১) এবং চারজন নির্দল প্রার্থী। বিরোধীদের এই ছত্রভঙ্গ অবস্থা বিজেপির কাছে স্বস্তিদায়ক।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত আরেক রাজ্য মেঘালয়ে এবারেও বহুমত অর্জন করতে পারল না ক্ষমতাসীন কনরাড সাংমার দল এন পি পি। ৬০টি আসনের মধ্যে তাদের সংগ্রহ ২৬টি। ১১টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টি। এছাড়াও টি এম সি ও কংগ্রেস পেয়েছে ৫টি করে আসন, ভয়েস অফ পিপলস পার্টি ৪টি , এইচ এস পি ডি পি ২টি , বিজেপি ২টি, পি ডি এফ ২টি এবং নির্দল ২টি আসন। ( একটির ফলাফল অপ্রকাশিত )। এখানে স্বস্তির খবর এই যে পূর্বে এন ডি এ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এন পি পি সরকার গড়তে বিজেপির দ্বারস্থ। বিজেপিও কনরাড সাংমাকে সমর্থন দেবে বলে ঘোষণা করেছে। আবার এককালে মেঘালয়ের অন্যতম শক্তি কংগ্রেস এখানে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। তৃণমূল কংগ্রেসও ব্যর্থ ঘোলা জলে মাছ ধরতে। তবে রাষ্ট্র বাদী শক্তি এখনও এখানে ততটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে নি। গতবারের ভোটেও বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ২টি। অধ্যুষিত এই রাজ্যে শক্তি বিস্তারে দ্রুত মন দেওয়া উচিত রাষ্ট্রবাদী কার্যকর্তাদের।
এরপর আসা যাক অন্যান্য রাজ্যের উপনির্বাচন বিষয়ে। উপনির্বাচন হয়েছিল যে সব রাজ্যগুলিতে সেগুলি হল অরুণাচল প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে ভোট হয়েছিল দুইটি কেন্দ্রতে বাকি সব জায়গায় একটিতে।
অরুণাচলের লুমলা বিধানসভা কেন্দ্রে বিজয়ী হল বিজেপি। উত্তর পূর্বের উন্নয়নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এই ফলাফল এবং ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ডের ফলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ঝাড়খন্ডে ক্ষমতাসীন জে এম এম এর বিরুদ্ধে গেল রামগড় কেন্দ্রের ফলাফল। এখানে জিতল এন ডি এ শরিক আজাসু। মহরাস্ট্রে ছিন্দওয়ারা কেন্দ্রেও বিজয়ী হল বিজেপি। এইসব ফলাফল স্বস্তিদায়ক। কিন্তু অস্বস্তিদায়ক হল মহারাষ্ট্রের কসবা পেঠ কেন্দ্র বিজেপির হাতছাড়া হওয়া। এই কেন্দ্র দীর্ঘদিন বাদে দখল করল কংগ্রেস। তামিলনাড়ুর ইরোড কেন্দ্রেও জয় পেল কংগ্রেস। উল্লেখ্য এই রাজ্যে ক্ষমতাসীন ডিএমকে জোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেস এবং ডিএমকের নেতা তথা বর্তমান তামিল মুখ্যমন্ত্রী স্টালিন হিন্দু বিরোধীতাতে বেশ এগিয়ে। এখানে জয়ললিতার মৃত্যুর পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে , সেটা পূরণ করা রাষ্ট্রবাদী শক্তির অন্যতম কর্তব্য। সেটা না হলে তামিলনাড়ুতে আগামী দিনে ভারত বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দেবে।
শেষে আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের সাগরদিঘী কেন্দ্রের ফলাফলে । এই কেন্দ্র তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নিল কমিউনিস্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার দুর্নীতির অভিযোগে এবং সরকারী কর্মচারীদের আন্দোলনে এই মুহূর্তে বিপর্যস্ত। তাই এই ফলাফলে অনেকেই উল্লসিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে সাগরদিঘি কেন্দ্রে অধিকাংশ ভোটার মুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত আর মুসলিম সম্প্রদায়ের পছন্দের দল তৃণমূল কংগ্রেস এই উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছিল এক হিন্দুকে ( দেবাশীষ বন্দোপাধ্যায় )। এটা মেনে নেয়নি মুসলিম ভোটারদের বেশিরভাগ অংশ। তাই তারা জেতাল আরেক সেক্যুলার এবং হিন্দু বিরোধী দল কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসকে। এই পর্যন্ত সাগরদীঘি কেন্দ্র থেকে বিজয়ী প্রার্থীরা (যে দলের প্রতিনিধিত্ব করুন না কেন) ছিলেন হিন্দু। এই প্রথম কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতায় এইখানের জনপ্রতিনিধি হলেন একজন মুসলিম। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের জন্য এটি অশনি সঙ্কেত। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তৈরি হয়েছিল বাংলাভাষী হিন্দুদের জন্য, কিন্তু ধীরে ধীরে এখানে জনপ্রতিনিধি বৃদ্ধি করছে মুসলিম সম্প্রদায়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কমিউনিস্ট – কংগ্রেস জোটের সদস্য সংখ্যা হল দুই এবং দুই জনেই মুসলিম। অতএব আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু আসাম ও ত্রিপুরার হিন্দুদের থেকে শিক্ষা না নিলে আরেকবার উদ্বাস্তু হওয়া সময়ের অপেক্ষা হবে।
সর্ব ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ভাবলে ২০২৪ -এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এই ফলাফল বিজেপি তথা রাষ্ট্র বাদীদের কাছে সন্তোষজনক। উত্তর পূর্বের একমাত্র মিজোরাম বাদে সকল রাজ্যে নির্ণায়ক হয়েছে বিজেপি। এখন সাতটি রাজ্যের মধ্যে চারটিতে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী, দুইটিতে বিজেপি সরকারের জোট সঙ্গী। তবে পূর্বের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আগামী দিনে হিন্দুরা বা বিজেপি কতটা জমি ধরে রাখতে পারবে সেটা নিয়ে সংশয় রয়ে গেল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রতিনিধি শূন্য হয়ে যাওয়া কমিউনিস্টরা এখনই সাগরদিঘির ফলাফলে উজ্জীবিত। তাদের এই উল্লাস যেন বন্ধুভাগ্যে সন্তান লাভের উল্লাস! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিশেষ করে হিন্দুদের বোঝাতে মাঠে নেমে পরেছে তারা। যদি তারা সফল হয় , তবে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গ পাবে হিন্দু বিরোধী তথাকথিত স্যেকুলার রাজ্য সরকার যা চিন্তা বৃদ্ধি করবে দিল্লির সরকারের। এখন পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রবাদী কার্য কর্তারা চিন্তা করুন যে তাঁরা কি নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে রণে ভঙ্গ দেবেন নাকি মাঠে নামবেন।