Opinion

বাংলাদেশের মাটিতে গণহত্যার জন্য পাকিস্তান কি কোনোদিন ক্ষমা চাইবে?

© অরুণ আনন্দ

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সামান্য উন্নতি দেখা দিয়েছে। তবুও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভয়াবহ অপরাধের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে পাকিস্তান সরকারের অনিচ্ছা তা প্রভাবিত করে চলেছে। ১৯৭১ সালের সহিংসতা যা হাজার হাজার বাংলাদেশীর হত্যার কারণ হয়েছিল, তা বাংলাদেশীদের সম্মিলিত চেতনায় একটি অবিস্মরণীয় চিহ্ন রেখে গেছে। সেই সময়কার বাংলাদেশের জনগণের ওই ভয়াবহ নৃশংসতার বেদনাদায়ক স্মৃতি কোনো দশক বা শতাব্দী মুছে ফেলতে পারবে না।

বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সংঘাতের প্রধান অগ্রদূত হয়ে ওঠে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম প্রত্যক্ষ সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০ সদস্যের শক্তিশালী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে (যার মধ্যে সাতটি  নারী আসনসহ সংরক্ষিত) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশে (বর্তমান পাকিস্তান) ৮১ টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যান্ডেট জিতেছে। 

মজার ব্যাপার হলো, কট্টর গণতন্ত্রী রূপে বিবেচিত জুলফিকার আলী ভুট্টো, নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিলেন, যার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক দেশের  সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটদের এই অসহিষ্ণুতা বেশিরভাগ বাঙালির কাছেই ছিল অপমানজনক আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  এই প্রেক্ষাপটে, রহমানের পাকিস্তানের সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বশাসন (ছয় দফা ঘোষণা) প্রদানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণশপথের মতো, এবং তার পেছনে থাকা আমলাতন্ত্রকে একত্রিত করা গুরুত্ব গ্রহণ করে। পাকিস্তানি এলিটরা, যারা এই প্রদেশটিকে তাদের উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল সম্পদ শোষণের জন্য, তারা এটিকে তাদের আধিপত্যের  হুমকি হিসাবে দেখেছিল।

এরপর যা ঘটে তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি চরম নৃশংসতা “অপারেশন সার্চলাইট” এর মাধমে, শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরবর্তীতে তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরের পর। তবে গ্রেফতারের আগে, তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ‘ঘোষণাপত্র’, এক ওয়ার’এর মাধমে পরের দিন চট্টগ্রামে ট্রান্সমিশনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। 

২৫ শে মার্চের সামরিক অভিযান, ঢাকার বিভিন্ন অংশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস সহিংসতা চালাতে দেখে, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার ফলে নিরাপত্তার নামে শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অন্যান্যরা হত্যা হন। এর পরবর্তীর নয় মাস যা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণ আত্মসমর্পণ দেখে , জামায়াত-এ-ইসলামীর মতো ইসলামী দলগুলোর মিলিশিয়াদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হয়, যার ফলে লাখ লাখ বাঙালি মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা তিন লাখ থেকে ৩০ লাখের মধ্যে। তারপর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশী মহিলাদের বিরুদ্ধে নৃশংস যৌন সহিংসতার নিয়মতান্ত্রিক প্রচারণার মাধ্যমে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, সেই সময়ের মধ্যে প্রায় ২০০,০০,০০ থেকে ৪০০,০০০ নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে মনে করা হয়। হামুদ-ইওর-রেহমান কমিশন (এইচআরসি),পাকিস্তান সরকারী কমিশনের রিপোর্ট যা ঢাকায় পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের কারণ অনুসন্ধান করে, বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীকর্তৃক চালানো ভয়াবহ সহিংসতার বিবরণ দিয়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা রেকর্ড করেছে। তবে রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা মাত্র ২৬ হাজার।

যাইহোক, ইতিহাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য মানুষের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরোধিতায় তাদের সাহসী প্রতিরোধকে সম্মান করে, যদিও বাংলাদেশী যোদ্ধাদের দ্বারা অর্জিত বেশ কয়েকটি কৌশলগত এবং অপারেশনাল বিজয় অনিবন্ধিত রয়ে গেছে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় তার ৯৩,০০০ সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এই গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার কখনই সেই ভয়াবহ ঘটনার জন্য কোনও অনুশোচনা প্রকাশ করেনি, এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলেনি। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক পাকিস্তানি তাদের বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত করে। বরং ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের সহিংস সামরিক অভিযানের ক্যাসুস বেলি হিসেবে তাদের সেনাবাহিনী বাঙালি-অবাধ্যতার আখ্যান দিয়েছে।

বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ যারা পাকিস্তানি অপরাধের পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে, তারা পাকিস্তানের কাছে অন্তত আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমা চাওয়ার অধিকার রাখে। ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে অতীতের এই ভুলগুলি স্বীকার করা এক ঐতিহাসিক পুনর্মিলনের পদক্ষেপ হতে পারে যা বাংলাদেশের জনগণের ভোগান্তির স্বীকৃতি দেবে। এটি ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারকে নিরাময়ের অনুভূতি সরবরাহ করতে পারে। এটি অতীতের ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করবে, অনুশোচনা প্রদর্শন করবে এবং যারা ভুক্তভোগী তাদের মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে।

তাছাড়া, ক্ষমা প্রার্থনা বিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে। এটি আরও সহযোগিতার পথ বানাতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক সম্পর্কের প্রতিশ্রুতির সংকেত দিতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Sorry! Content is protected !!