Articles

বাল্মীকি কথা

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

বাল্মীকি হলেন আদি কবি; রামায়ণের রচয়িতা। বাল্মীকি আসলে কে ছিলেন, কি তাঁর পরিচয় ? আসুন আজ আমরা দেখি ভারত বর্ষের শ্রেষ্ঠ কবি বাল্মীকির পরিচয় ।

কবি কৃত্তিবাসের লেখা বাংলা রামায়ণ পড়ে আমরা জেনে এসেছি, বাল্মীকি প্রথম জীবনে ছিলেন “দস্যু রত্নাকর।” এই ঘোরতর পাপী মানুষটির মুখ দিয়ে কিছুতেই রামনাম বেরোচ্ছিল না। অনেক ঘটনার পর অবশেষে ব্রহ্মার বরে অনেক বছর “মরা” “মরা” জপতে জপতে তবে তার মুখ থেকে “রাম” “রাম” বেরিয়েছিল। আর এই রাম নাম জপতে জপতে তাঁর শরীরে তৈরি হয়ে যায় উইঢিপি। উইয়ের আরেক নাম “বল্মীক”, আর তা থেকেই দস্যু রত্নাকরের নাম হয়ে গেল বাল্মীকি মুনি। এরপর বাল্মীকি রচনা করেন রামায়ণ।

এবার থামতেই হচ্ছে। কারণ, কবি কৃত্তিবাস নিজেই বলছেন,

“নাহিক এসব কথা বাল্মীকি বচনে।”
বিস্তারিত লিখিত অদ্ভুত রামায়ণে। ।”

অর্থাৎ কৃত্তিবাস নিজে থেকেই এইসব কথা বলেছেন, স্বয়ং বাল্মীকি তাঁর রচিত রামায়ণে এইসব লেখেন নি।
এখন প্রশ্ন, কৃত্তিবাস এসব তথ্য তাহলে পেলেন কোথায়?

এ প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, স্কন্দপুরাণ অনুসারে বাল্মীকির শৈশব থেকে যৌবনকাল কেটেছিল অরণ্যবাসী কিরাত সম্প্রদায়ের লোকজনদের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তিনি আর্য শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ব্রাহ্মণ হোন। স্কন্দপুরাণ অনেক পরের লেখা। কৃত্তিবাস স্কন্দপুরাণের এই বিষয়টিকেই কাজে লাগিয়েছেন, বলা যায়।

বাল্মীকি ছিলেন ভৃগুবংশজাত, যে বংশের বিখ্যাত ঋষিরা হলেন চ‍্যবন, ঋচিক, জমদগ্নি ও পরশুরাম। সম্ভবত বাল্মীকি ছিলেন ঋষি চ‍্যবনের উত্তরসূরী।

পৌরাণিক তথ্য অনুসারে, বাল্মীকি ছিলেন দেবতা বরুণের ঔরসজাত ভৃগুবংশীয় আর্যপুত্র। প্রথমথেকেই তাঁর কবিখ‍্যাতি ছিল এবং সেজন্য ব্রহ্মা তাঁকে রামায়ণ রচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাই আদি পুরাণে বাল্মীকি প্রথম থেকেই ঋষি হিসেবেই পরিচিত। কোথাও তাঁর নাম “দস্যু রত্নাকর” নয়।

আর কৃত্তিবাসী রামায়ণের সব লেখাও কৃত্তিবাসের নয়। অনেক কবির লেখা কৃত্তিবাসের সঙ্গে জুড়ে গেছে। “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ” থেকে একবার চেষ্টা হয়েছিল, প্রক্ষেপের প্রলেপ থেকে মূল কৃত্তিবাসী রামায়ণকে উদ্ধারের। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ড: হীরেন্দ্রনাথ দত্তকে। এরপর বিশেষ বিবেচনার পর “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ” প্রকাশ করে “অয‍্যোধ‍্যা” ও “উত্তর কাণ্ড।” কিন্তু পণ্ডিতমহলে তা গ্রাহ‍্য হয়নি বলে সে উদ্যোগের সেখানেই ইতি ঘটে।

এবারে দেখা যাক বাল্মীকি রামায়ণে বাল্মীকির পরিচয় কি আছে। বাল্মীকি রামায়ণ অনুযায়ী একদিন মহর্ষি বাল্মীকি যখন তমসা নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিলেন , তখন তিনি দেখেন এক নিষাদ মিলন রত এক জোড়া ক্রৌঞ্চ পাখির মধ্যে পুরুষ পাখিটিকে তীর মেরে হত্যা করল। এই দৃশ্য দেখে মহর্ষি বাল্মীকির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক ছন্দোবদ্ধ পদ, যা ব্রহ্মার আশীর্বাদে পরবর্তীকালে শ্লোক নামে পরিচিত হয় :

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং
ত্বমগমশ্শাশ্বতীস্সমা: ৷
যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী: কামমোহিতম্ ৷৷”1.2.15৷৷

অর্থ: হে নিষাদ , যেহেতু তুমি মৈথুন রত এক ক্রৌঞ্চকে বধ করেছ , সেহেতু তুমি সারাজীবন প্রতিষ্ঠা পাবে না ।

মহর্ষি বাল্মীকির এই শ্লোক সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক বলে পরিগণিত হয়। এই শ্লোকটি শুনে স্বয়ং ব্রহ্মা মহর্ষি বাল্মীকির কুটিরে প্রকট হন এবং মহর্ষি বাল্মীকিকে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দেন।
মহর্ষি সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

বাল্মীকি রামায়ণে বাল্মীকির পিতৃ পরিচয় ও পাওয়া যায়। উত্তর কাণ্ডে যখন বাল্মীকি শ্রীরামের রাজসভায় আবির্ভূত হয়ে সীতার চরিত্রের শুদ্ধতার কথা উচ্চারণ করেন এবং শ্রীরামকে মনে করিয়ে দেন কুশ ও লব শ্রীরাম ও জানকীর সন্তান। এখানে তিনি নিজেকে প্রচেতার ( বরুণ দেব ) দশম পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন।

প্রচেতসোহহং দশম: পুত্রো রাঘবনন্দন।
ন স্মরাম্যনৃতং বাক্যমিমৌ তু তব পুত্রকৌ ।। 7. 19. 96 ।।

সীতা দেবীর বাল্মীকির আশ্রমে বসবাস এবং শ্রীরামের রাজসভায় বাল্মীকির আবির্ভাব প্রমাণ করে রাম জন্মের আগে রামায়ণ লেখা হয় নি। তাছাড়া বাল্মীকি রামায়ণের একেবারে প্রথম সর্গতে আমরা দেখি বাল্মীকি এবং দেবর্ষি নারদের কথোপকথন। যেখানে মহর্ষি বাল্মীকি নারদকে একজন আদর্শ , চরিত্রবাণ রাজার পরিচয় জিজ্ঞাসা করছেন । নারদ তখন তাঁকে শ্রীরাম এর কথা শোনাচ্ছেন।

ইক্ষ্বাকুবংশপ্রভবো রামো নাম জনৈশ্শ্রুত: ৷
নিয়তাত্মা মহাবীর্যো দ্যুতিমান্ধৃতিমান্ বশী ৷৷1.1.8৷৷

ইনি ইক্ষ্বাকু নামক রাজার বংশজাত, রাম ( যিনি সবাইকে আনন্দদান করেন ) নামে পরিচিত, দৃঢ় প্রকৃতি সম্পন্ন, অতুল শক্তির অধিকারী, দ্যুতিমান, ধৃতিমান, সমস্ত ইন্দ্রিয়কে নিজের বশে
আনতে সক্ষম l

এই শ্লোক প্রমাণ করে বাল্মীকি রামায়ণ রচনার পূর্বেই শ্রীরাম রাজা রূপে খ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ বাল্মীকি রাম জন্মাবার পূর্বে রামায়ণ রচনা করেন নি।

পরিশেষে এই কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বামী বিবেকানন্দ 1900 খ্রিস্টাব্দের 31 জানুয়ারি
ক্যালিফোর্নিয়াতে রামায়ণ বিষয়ে একটি বক্তৃতা করেন। সেখানে উনি মহর্ষি বাল্মীকির
জীবনে দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনী ব্যক্ত করেন। হয়তো তিনিও কৃত্তিবাসের রচনা অনুযায়ী এই বর্ণনা করেছিলেন। তবে তাঁর এই বর্ণনা বাল্মীকি মাহাত্ম্য কিছু কমিয়ে দেয় না। বরং এতে প্রমাণিত হয় রাম নামের মহিমা । শ্রীরাম প্রভুর নাম একজন ডাকাতকেও মহাকবি স্তরে উত্তরিত করতে পারে। আবার দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনী এটাও প্রমাণ করে যে সুপ্রাচীন ভারতীয় সমাজে একজন প্রান্তিক মানুষ ও কিভাবে মূলস্রোতে আসতে পারত কিম্বা একজন শুদ্র কিভাবে ব্রাহ্মণ স্তরে উত্তরিত হতে পারত।

তথ্যসূত্র :

১. শ্রীমৎ বাল্মিকী রামায়ণ : গীতা প্রেস গোরক্ষপুর।

২. বাল্মীকি কোনদিন দস্যু রত্নাকর ছিলেন না: উত্তম মন্ডল : risingbengal.in

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Sorry! Content is protected !!