মন্দির ধ্বংসকারী এবং হিন্দুদের উপরে জিজিয়া চাপানো মুঘল আওরঙ্গজেব

লেখক: অনুপম কুমার সিংহ, ১১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে OpIndia-তে প্রকাশিত হয়।

অনুবাদ: অয়ন চক্রবর্তী

বামপন্থী ইতিহাসবিদরা যতই চেষ্টা করুন, তারা কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে; হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করাটাই ছিল আওরঙ্গজেবের ট্রেডমার্ক। তার ভাবমূর্তি এতটাই কলঙ্কিত, হাজার চেষ্টাতেও তা ধোয়া সম্ভব নয়। তিনি কত সহস্র হিন্দুকে হত্যা করেছেন, মন্দির ভেঙ্গেছেন, তা গোণা প্রায় ‘অসম্ভব’ একটা কাজ। যার মধ্যে দিল্লির কলকা মন্দির, অযোধ্যার র‍্যাম মন্দির ও কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরও আছে। শুধু হিন্দু নয়, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান এমনকি শিয়া, বোহরা, আহমাদিয়া মুসলিমদেরও ওপর ব্যাপক নির্যাতন করেছেন। তাদের ‘অপরাধ’ ছিল একটাই — তারা সুন্নি মুসলিম ছিলেন না, যা স্বয়ং আওরঙ্গজেব পালন করতেন।

আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে বেশি ‘ক্রোধ’ ছিল হিন্দুদের ওপর। একজন ধর্মোন্মাদ হিসাবে কুখ্যাত আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ওপর এমন কোনও প্রকার অত্যাচার নেই, যা করেন নি।

আকবরের সময়ে উঠে যাওয়া জিজিয়া কর আবার আওরঙ্গজেব ফিরিয়ে আনেন। সে করের পরিমাণ এত চড়া ছিল যে, বহু দরিদ্র হিন্দু করভার সহ্য করতে না পেরে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত হন। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য ধর্মের লকের ক্ষেত্রেও। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জিজিয়া কর কেবল অমুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য, এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। দিল্লি সুলতানিয়ৎ যুগেও জিজিয়া কর চালু ছিল।

রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকারের মত ইতিহাসবিদরা তাদের গ্রন্থে দেখিয়ে দিয়েছেন, সে যুগে হিন্দুরা তাদের ব্যবহার্য সব জিনিসের ওপরেই কর দিতে বাধ্য থাকত। গৃহপালিত পশুপক্ষী থেকে শুধু করে বাগান করতে গেলেও কর দিতে হত। সব কর মেটাতে মেটাতে হিন্দুদের হাতে প্রায় কিছুই থাকত না।

জিজিয়া করের দর কেমন ছিল? বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ সালে জিজিয়া করের প্রত্যাবর্তন ঘটাবার সময়ে হিন্দুদের তিন ভাগে ভাগ করেন — ধনী হিন্দু, মধ্যবিত্ত হিন্দু ও দরিদ্র হিন্দু। যেসব হিন্দুদের বার্ষিক আয় ছিল ২৫০০ টাকারও বেশি, তাদের ৪৮ দিরহাম বা ১৩ টাকা বার্ষিক জিজিয়া দিতে হত। অনুরূপ ভাবে যাদের আয় ছিল ২৫০ টাকার নিচে, তাদের ২৪ দিরহাম বা ৬.৫০ টাকা জিজিয়া কর দিতে হত।

সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষণ আসত দরিদ্র শ্রেণীর হিন্দুদের ওপর আওরঙ্গজেব জানতেন, হিন্দুদের মধ্যে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাই তাদের ধর্মান্তরিত করে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেন। ১৬৭৯ সালে যাদের বার্ষিক আয় ছিল ৫২ টাকার কম, তাদের দরিদ্র ধরা হত। এত কম আয় করা সত্ত্বেও তাদের ওপর ১২ দিরহাম বা ৩.২৫ টাকা জিজিয়া দিতে হত। অনুপাতের হিসাবে মোট আয়ের মাত্র ০.৫২% উচ্চবিত্তদের, ২.৬% মধ্যবিত্তদের ও ৬.২৫% নিম্নবিত্তদের দিতে হত জিজিয়া হিসাবে। যারা কর দিতে পারত না, বা দিত না; তাদের ওপর ভয়াবহ সব অত্যাচার দিতে হত।

জিজিয়া কর আদায়ের পর সে অর্থ দিয়ে কি করা হত? উত্তর খুব সহজ – হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য ব্যবহৃত হত। উত্তর ভারত জুড়ে হিন্দু প্রধান রাজ্যের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভাবে জিহাদ করতে বেরুতেন আওরঙ্গজেব, সে কাজে সাহায্য করতেন রাজপুতরা। রাজপুতদের প্রভুত পরিমাণে উৎকোচ হিসাবে জিজিয়া থেকে আদায়কৃত অর্থ দেওয়া হত; এবং তাদের হিন্দুদেরই বিরুদ্ধে লড়তে বাধ্য হত। মুসলিম সৈন্যরা যুদ্ধে জিতলে হিন্দুদের সম্পদ লুণ্ঠন করত, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করত; মন্দির অপবিত্র করত। মুসলিম সেনাদের বেতন আসত জিজিয়া থেকেই। অর্থাৎ হিন্দুরা নিজেদের ওপর নির্যাতনের বন্দোবস্ত করত স্বোপার্জিত অর্থ দিয়ে – জিজিয়া করের মাধ্যমে!

জিজিয়া করের ভার সহ্য করতে না পেরে বহু হিন্দু এক প্রকার বাধ্য হয়েই ধর্মান্তরিত হয়েছে। দরিদ্র হিন্দুরা বুঝেছিল যে, ধর্মান্তরিত হলে অন্তত জিজিয়া দিতে হবে না। খুব কম লোকই জানেন যে, ভারতের প্রায় ৭০% মুসলিম আওরঙ্গজেবের সময়েই ধর্মান্তরিত হয়েছে। সে সময়ে এত বেশি মানুষ দলে দলে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল যে, মুঘলদের বার্ষিক আয় কমছিল। কেননা, রাজকোষে আয় দেবার মত হিন্দুদের সংখ্যা কমছিল। এই সব কারণে আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ পর্যায়ে রাজকর্মচারীদের ছাঁটাই করতে হচ্ছিল, সেনাবাহিনীর আয়তন কমাতে হচ্ছিল। এই তথ্য এমনকি বামপন্থী ইতিহাসবিদরা ঢাকতে পারেন নি।

এটা ভাবলে ভুল হবে শুধুমাত্র মুসলিমদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য জিজিয়া করের প্রত্যাবর্তন ঘটানো হয়েছিল। বাস্তবে তা করা হয়েছিল মুসলিম জনগণ ও ধর্মগুরুদের সন্তুষ্ট করার জন্য। ঐ সময়ে মারাঠারা যেভাবে শিবাজির নেতৃত্বে মুঘলদের চাপে রাখছিল, তাতে উত্তর ভারতের মুসলিম জগত আওরঙ্গজেবের ওপর বিরক্ত হচ্ছিল। তাদের তরফ থেকে বিদ্রোহ আসার সম্ভাবনা ঠেকাতে আওরঙ্গজেব তাই জিজিয়া কর ফেরান। ধর্মগুরু ও সাধারণ মুসলিমদের দায়িত্ব দেওয়া হয় অমুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করতে। প্রতিবেশীদের কাছে জিজিয়া করের নামে লাঞ্ছিত হবার আশঙ্কায় হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হতে পারে, এমন সম্ভাবনা দেখেছিলেন আওরঙ্গজেব। তার ধারণা ভুল ছিল না, তা পরবর্তী ঘটনাক্রমে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল।

এই সময়ে আওরঙ্গজেবের কারণে উত্তর ভারতের মুসলিম ধর্মগুরুরা দুহাতে টাকা কামাতে শুরু করে জিজিয়া কর আদায়ের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জিজিয়া করের কিছু অংশ কিন্তু ধর্মগুরুদের পকেটেও যেত – শুধু সরকারের পকেটে নয়। জিজিয়া করের মাধ্যমে মুসলিমরা যে হিন্দুদের চেয়ে ‘সুপিরিয়র’ জাত সেটা প্রমাণ করাই ছিল মূল লক্ষ। এবং তাতে সফলও হয়েছিল আওরঙ্গজেব। বহু বছর ধরে বামপন্থী ইতিহাসবিদরা জিজিয়া করকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ কারণে আদায় করা হত বলে দেখানোর চেষ্টা করেছেন – তারা কিছুতেই এর পেছনে ‘মজহবি সাম্রাজ্যবাদী’ কারণকে দেখাতে রাজি হন নি। তারা ভারত যে ঐ সময়ে একটি শরিয়া রাষ্ট্র ছিল, এই কথাটাই স্বীকার করতে চান না। জিজিয়া কর যে হিন্দুদের প্রকাশ্যে অপমান করার মজহবি কৌশল ছিল, সেটা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না বামপন্থী ইতিহাসবিদরা। কিন্তু তাদের অস্বীকৃতিতে ইতিহাস পাল্টে যায় না।

ইংরেজ ইতিহাসবিদ মার্ক জেসন গিলবার্ট তার ‘সাউথ এশিয়া ইন ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি’ গ্রন্থে পরিস্কার দেখিয়েছেন কিভাবে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের আর্থিক, সামাজিক, ধার্মিক ও রাজনৈতিক কারণে হেয় করার কৌশল হিসাবেই জিজিয়া কর আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যখন হিন্দুরা জিজিয়া কর দিত, তখনই তাদের কর আদায়কারিদের তরফ থেকে কোরআনের বিশেষ বিশেষ ‘আয়াত’ উচ্চারণ করার জন্য চাপ আসত, যেখানে অমুসলিমদের মানবেতর পশুদের সাথে সমতুল্য দেখা হয়েছে। এইভাবে হিন্দুদের হেয় করাটা আওরঙ্গজেব ‘সুন্নত’ মনে করতেন।

এতেই শেষ নয়, আওরঙ্গজেবের আমলে যতই যোগ্যতা থাকুক, অমুসলিমরা কোনও ভাল সরকারি পদ পেত না। তার আগে যতগুলি মুঘল সম্রাট ছিল, প্রায় সবাই রাজপুতদের বড় বড় পেত দিতেন, এমনকি সেনাধ্যক্ষ হতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের আমলে সেটা চিরতরে বন্ধ হয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই রাজপুতদের মনে ক্ষোভ জাগে এবং বিদ্রোহ শুরু করে। এই কারণে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়।

১৬৮৭ সালে আওরঙ্গজেব শরিয়া আইন আরও কঠোরভাবে বলবত করেন। এই সময়ে হিন্দুরা নাচগানও করতে পারত না। যা ছিল তাদের সংস্কৃতির অংশ।

এই সময়ে রাজাজ্ঞার মাধ্যমে আওরঙ্গজেব মুসলিম মেয়েদের ত বটেই, অমুসলিম মেয়েদেরও ‘পর্দা’ করা বাধ্যতামুলক করেন। মুসলিমদের গোঁফ ছাড়া কার আঙ্গুল লম্বা দাড়ি রাখা বাধ্যতামুলক করেন। তার ধারণা ছিল গোঁফ রাখলে কোরআন পাঠ করলে তার শব্দ ‘আল্লাহের’ কানে পৌঁছবে না।

এই সময়ে হিন্দুরা এমনকি প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ করতে পারত না, মেলার আয়োজনও করতে পারত না। এতে হিন্দুরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন তার অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং প্রকাশ্যে বিদ্রোহ শুরু করে। আগে যেসব বিদ্রোহ হত হিন্দুদের তরফ থেকে তা ছিল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্ত। কিন্তু এবার যে বিদ্রোহ শুরু হয়, তার লক্ষ্য ছিল মুসলিম শাসন থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া। যা শুরু হয়েছিল শিবাজির হাত থেকে। ১৬৬৯ সালে বুন্দেলখন্ডের শাসক ছত্রশালও মুঘল অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র রাজ্য বানিয়ে রাজত্ব করতে থাকেন। একই কাণ্ড ঘটে রাজপুতানার রাজসিংহ, আসামেও। কেউই আওরঙ্গজেবের প্রকাশ্য হিন্দু বিদ্বেষ মেনে নিতে পারেন নি। যা শেষ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে।

error: Sorry! Content is protected !!