Articles

ইরাকের পাহাড়ে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ছড়ানো ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অস্তিত্ব। তিনি ছিলেন চক্রবর্ত্তী রাজা। চক্রবর্ত্তী রাজা তাঁকেই বলা হয়, যার রাজত্বে একই সময়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত হয়। অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী যার রাজত্ব তিনিই চক্রবর্ত্তী রাজা। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে রাজা দশরথ রাণী কৈকেয়ীকে তাঁর এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের বর্ণনা করেন।এই বর্ণনাতেও পাওয়া যায়, রাজা দশরথের রাজত্ব পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড জুড়েই বিস্তৃত ছিলো। দক্ষিণের দ্রাবিড়দেশ, সিন্ধু-সৌবীর দেশ, সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণাপথ, বঙ্গদেশ, অঙ্গদেশ, মগধ ও মৎস্যদেশ, কাশি, কোশল – এই সকল সমৃদ্ধ দেশ সহ, যতদূর পর্যন্ত সৌরচক্র আবর্তিত হচ্ছে এই বসুন্ধরার ততদূর পর্যন্ত ভূখণ্ড রাজা দশরথের অধীন।

যাবদাবর্ততে চক্রং তাবতী বসুন্ধরা৷৷
(রামায়ণ: অযোধ্যা, ১০.৩৬)

শ্রীরামচন্দ্র বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর পিতা দশরথ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে তিনিও পৃথিবী শাসন করেছেন। এ প্রসঙ্গে রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে বলা হয়েছে :

আজানুলম্বিবাহুঃ স মহাবক্ষঃ প্রতাপবান্।
লক্ষণানুচরো রামঃ শশাস পৃথিবীমিমাম্।।
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ১২৮.৯৬)

“শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন আজানুলম্বিত বাহু, অর্থাৎ দীর্ঘবাহু। তাঁর বক্ষঃস্থল বিশাল এবং বিস্তৃত। তিনি ছিলেন মহাপ্রতাপশালী। অনুজ লক্ষণকে সাথে নিয়ে মহারাজ শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবী শাসন করেন।”

শ্রীরাম এবং শ্রীরামকথা সমগ্র জগতে প্রচারিত। শ্রীরামচন্দ্রের মহিমা কেউ ম্লান করতে পারবে না। যতদিন এ জগত আছে, ততদিনই শ্রীরামের মহিমা কীর্তন করে জগত মহিমান্বিত হবে। বিষয়টি রামায়ণের আদিকাণ্ডেই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যতদিন এ জগতে সকল গিরি পর্বত এবং নদী থাকবে ততকাল ধরেই রাম এবং রামকথা জগতের সর্বত্র বহমান থাকবে।

যাবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবদ্ রামায়ণকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি।।
(রামায়ণ: ১.২.৩৬-৩৭)

ভারতবর্ষ থেকে ৩৭৪৫ কিমি দূরে ইরাকের পাহাড়ে খোদিত রয়েছে শ্রীরামচন্দ্র এবং হনুমানের অবয়বের সাদৃশ্যে রিলিফ ভাস্কর্য । স্থানটি হলো, ইরান, কুর্দিস্তান আর তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল জাগরোস পর্বতমালায় দারবান্দ-ই-বেলুলাতে।খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে সেই অঞ্চলে গড়ে উঠে প্রাচীন বসতি। সেই প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শন ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে অঞ্চলটিতে। দুর্গম পর্বতের গায়ে খোদাই করে তৈরি করা রিলিফ ভাস্করটিতে দেখা যায় একজন রাজা একহাতে ধনুক নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ। অন্যহাতে ধারালো খঞ্জর। কোমরে তলোয়ার গোঁজা। পায়ের কাছে দুইজন ব্যক্তি। একজন পদদলিত এবং অন্যজন জোড়হাতে উপবিষ্ট। এই রিলিফ ভাস্কর্যের তীরধনুক হাতে যুদ্ধরত ব্যক্তির অবয়ব অবিকল শ্রীরামচন্দ্রের মত। পায়ের কাছে দুজন ব্যক্তির অবয়বের মধ্যে আয়তনে ছোট সামনাসামনি জোড়হাত করে উপবিষ্ট ব্যক্তিটি দেখতে রামভক্ত হনুমানের মত। সাধারণত ভারতবর্ষে রামচন্দ্রের মূর্তি এভাবেই তৈরি করা হয়। তবে ইরাকের ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, এই ধনুক নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ ব্যক্তিটি ইরানের প্রাচীন পাহাড়িদের রাজা তারদুন্নি। ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী, তারদুন্নি ছিলেন ইক্কির পুত্র। আর ইক্কি জাগরোস পর্বতাঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রাচীন রাজ্যের শাসক ছিলেন।

এ পুরাতাত্ত্বিক বিষয়টি বহুদিনই সকলের লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলো। ২০১৯ সালের জুন মাসে, ভারতীয় এক প্রতিনিধিদল বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়ে ইরাকে গমন করে। তারা ভগবান রামের পাহাড়ে খোদিত ভাস্কর্যের সত্যতা সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে। ভারত সরকার এবং ইরাকের সংস্কৃতি মন্ত্রক যৌথভাবে বিষয়টি নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু করে। সেই গবেষণার ধারাবাহিকতায় তথ্য সংগ্রহে অযোধ্যা শোধ সংস্থানের পক্ষ থেকে ইরাকের ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রদীপ সিং রাজপুরোহিত উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগে অংশ হিসেবে তারা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে স্থানটিতে পরিদর্শনে যান। ইর্বিলের কনসুলেট সি চন্দ্রমৌলী, সেক্রেটারি ধর্মেন্দ্র সিংহ, সুলেইমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এবং কুর্দিস্তানের ইরাকি রাজ্যপাল সাথে থাকেন। পরিদর্শন পরবর্তীতে তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী প্রাথমিক অনুসন্ধানে অযোধ্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট দাবি করে, ধনুকধারী যুদ্ধরত ব্যক্তিটি আর কেউ নন, ভগবান রামচন্দ্র।অযোধ্যা শোধ সংস্থানের পরিচালক যোগেন্দ্র প্রতাপ সিং-এর মতে, সামনে উপবিষ্ট ক্ষুদ্র অবয়বটি আর কেউ নন, প্রবল বলশালী হনুমান।এই রিলিফ চিত্রকর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য ইরাক সরকারের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বহু জায়গায় রামের নানা প্রাচীন মূর্তি ও ম্যুরাল রয়েছে। সেসব প্রতিরূপ এনে অযোধ্যায় রাখা হবে।তিনি আরও বলেন, বেলুলা পাসে ভগবান রামের রিলিফ ভাস্কর্য প্রমাণ করে ভারতীয় এবং মেসোপটেমিয়ান সংস্কৃতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি। তাই এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা প্রয়োজন।

ইরাকের জাগরোস পর্বতমালায় দারবান্দ-ই-বেলুলাতে
শ্রীরামচন্দ্রের রিলিফ ভাস্কর্যটিতে বনবাস সময়ের ঘটনা বিধৃত হয়েছে। তাঁর দেহের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত। তিনি নগ্ন পায়ে বনবাসের কারণে রাজকীয় আভূষণ পরিত্যাগ করে স্বল্পবসন পরিধান করে আছেন। সুগ্রীবের ভাই বালিকে বধ করার দৃশ্যের সাথে এই ভাস্কর্যটির অত্যন্ত সাদৃশ্য রয়েছে। শ্রীরামচন্দ্র বালিকে হত্যার জন্য তীর নিক্ষেপ করলে, মৃত্যুপথযাত্রী বালি শ্রীরামচন্দ্রের পদতলে আশ্রয় নেয়। তাই পদদলিত ব্যক্তিটি বালি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে সামনের হাত করজোড়ে করা ব্যক্তিটি অবশ্যই হনুমান অথবা সুগ্রীবও হতে পারে।

প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে দজলা ( টাইগ্রিস) ও ফোরাত ( ইউফ্রেটিস) এই দুই নদীকে কেন্দ্র করে, এই দুই নদীর মধ্যবর্তী উর্বর ভূমিতে মেসোপটেমীয় সভ্যতা গড়ে উঠে। ভারতবর্ষীয় সভ্যতার বাইরে এই সভ্যতাটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। তুরস্ক এবং ইরানের সামান্য অংশ সহ মেসোপটেমীয় সভ্যতার অধিকাংশই ইরাক এবং সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাই ইরাক এবং সিরিয়াকেই মেসোপটেমীয় সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। মেসোপটেমিয়ার উত্তরাংশের নাম অ্যাসিরিয়া ও দক্ষিণাংশের নাম ব্যাবিলন। ব্যাবিলনের দুটি অংশ। উত্তর অংশের নাম আক্কাদ এবং দক্ষিণ অংশের নাম সুমের। আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর পূর্বে সুমের জাতি মেসোপোটেমিয়ায় বসতি গড়ে তোলে। ‘সুমের’ শব্দটি গ্রিকদের দেয়া নাম। এর অর্থ কালো মানুষ। পৃথিবীর সুমেরীয় সভ্যতার ইতিহাসে রাম নামে দুইজন বিখ্যাত রাজাকে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একজন ষাট বছর রাজত্ব করেছেন।ভরত-সিন বা ওয়ারদ-সিন (Warad-Sin) নামেও একজন রাজার নাম পাওয়া যায়। যিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭০ থেকে ১৭৫৮ শাসন করেন। পিতার শক্তিতেই তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন বলে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।বারোবছর রাজত্বের পরে তার উত্তরসূরী হিসেবে ক্ষমতায় আরোহন করেন রাম-সিন (Rim-Sin 1). তিনি আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ১৭৫৮ থেকে ১৬৯৯ পর্যন্ত শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম রাম-সিন (Rim-Sin 1). কিউনিফর্ম লিপিতে তাঁদের দুজনের নাম হলো রাম সিন (Rim Sin) এবং ভরত সিন (Warad-Sin). তাঁদের দুজনের বোন এন-এনে-ডু (En-ane-du) ছিলেন চন্দ্র দেবতার উপাসক। চন্দ্রের মত সৌন্দর্যের কারণে আমরা যেমন রাম নামের সাথে চন্দ্র যুক্ত করে রামচন্দ্র বলি। মজার বিষয়, ঠিক তেমনি কিউনিফর্ম লিপিতে ‘Sin’ শব্দটির অর্থ চন্দ্র। বিষয়টি অত্যন্ত কৌতুহল উদ্দীপক।

রাম নামটি মেসোপটেমীয় বা আরবীয় সভ্যতার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। ফিলিস্তিনের ‘রামাল্লা’ সহ ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে রাম শব্দটির উচ্চারণগত সাদৃশ্য আজও পাওয়া যায়। তবে এই রাম শব্দটিকে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে মুছে দিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিবিধ সচেতন প্রয়াস রয়েছে।সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদের নামের একটি নিষিদ্ধ তালিকা রয়েছে। সেই তালিকায় প্রায় পঞ্চাশটি নিষিদ্ধ নামের তালিকা রয়েছে। যে নাম সৌদি আরবের কোন শিশুর রাখা যায় না। কারণ তাদের ভাষায় সে নামগুলো সামাজ এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। নিষিদ্ধ এ সকল নামগুলোই প্রায় আরবি শব্দ । এই আরবি ভাষায় নিষিদ্ধ নামের মধ্যে ‘Rama’ অন্যতম। সৌদি আরবের এই নির্দেশনাটি দুটি বিষয় প্রমাণ করে যে, রাম নামটি সেই ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো এবং অনেকেই সেই নামটি তাদের শিশুদের জন্যে রাখতে চান। কিন্তু রাষ্ট্র আইন করে সেই নামটি থেকে দূরে থাকতে জনগণকে বাধ্য করছে।

লেখক পরিচিতি:

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

error: Sorry! Content is protected !!