সাভারকর ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী

© শে খ র ভা র তী য়

নীচে যে ছবিগুলি দিয়েছি তা দুটিই জেলের ছবি। দাঁড়ান, সন্দেহে ভ্রু কুঁচকাবেন না। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না৷

যে ছবিটি প্রাসাদের মতো লাগছে ওটি পুনের আগা খান প্যালেস। এখানেই ৯ অগাস্ট ১৯৪২ সাল থেকে ৬ মে ১৯৪৪ পর্যন্ত জেলবন্দি ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী), তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী, মহাত্মার সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, এবং গান্দী ঘনিষ্ট সরোজিনী নাইডু, ডঃ সুশীল নাইয়াররা। আগা খান প্যালেসের যে রুমে গান্ধী থাকতেন সেটির ছাদ ছিল বিশাল উঁচুর রুমের দৈর্ঘ প্রস্থ উচ্চতাও ছিল রাজপ্রাসাদেরই মতো৷ রুমের জানলা খুললে সামনে ছিল বিশাল সাজানো বাগান, গান্ধীদের দেখাশোনার জন্য ছিল পরিচারক (যদিও সংখ্যায় কম) এবং ব্রিটিশ শাসক ও কংগ্রেসের নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আলোচনা করতে আগা খান প্যালেসে আসতেন৷

ছবি: আগা খান প্যালেস

অন্য যে ছবিটি রয়েছে সেটিও জেলের ছবি, একটা এই রুমটির দৈর্ঘ্য মেরেকেটে সাড়ে আট ফুট, প্রস্থ আরও অনেকটা কম, উচ্চতা প্রায় ১৪.৫ ফুট৷ আন্দামানের নির্জন সমুদ্রের এককোনে জনমানবহীন এই জেলের কুঠুরি, যার প্রায় ৯.৫ ফুট হাইটে একটি ঘুলঘুলির মতো জানালা দেওয়া থাকত, যেটা দিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনা যেত, কিন্তু শত চেষ্টা করেও সমুদ্র দেখা যেত না৷ দাঁড়ান দাঁড়ান, এখানেই শেষ নয়, এই জেলের যে গরাদ যেদিকটা দিয়ে কিছুটা আলো আসত সেখানেও গরাদের সামনে একটা ছোট বাগান মতো জায়গা ছিল, বেশ সাজানো গোছানো একটা ছোট্টো বাগান। কিন্তু পার্থক্যটা হল এই বাগানে আগা খান প্যালেসের মতো ফুল ফুটত না, প্রজাপতি আসত না৷ এই বাগানে লাগানো ছিল প্রকান্ড একটা ফাঁসিকাঠ। যেখানে প্রায়শই ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে এসে ফাঁসিতে ঝোলাত ব্রিটিশ শাসকেরা৷ ফাঁসিতে যাওয়ার আগে, ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় একজন জীবিত মানুষের মর্মান্তিক চিৎকার শুনতেন এই জেলে থাকা ভারত মায়ের ছেলেটি৷ ব্রিটিশ জেলাররা ইচ্ছে করে তাঁর সেলে এসে বলে যেত
-দেখ আজ একে ঝোলানো হচ্ছে এরপরে এঝভাবেই কোনও দিন তোকে ঝোলাব৷

ছবি: এই ঘরে বন্দী ছিলেন সাভারকর

ভারতীয়দের ফাঁসিতে ঝোলার সময়কার মর্মান্তিক চিৎকার সারা রাতদিন ধরে ওই ছোট্ট কুঠুরিতে প্রতিধ্বনিত্ব হত, একটা চিৎকার ফিকে হয়ে আসার আগেই আরএকজন ভারতীয় বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝোলাত ব্রিটিশরা! একটা জেলবন্দি তারই চোখের সামনে রোজ বা কয়েকদিন ছাড়া তারই পরিচিত বন্ধু বা সহযোদ্ধাদের একজনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে, না কল্পনাও করতে হবে না দৃশ্যটা শুধু মনে একবার ভাবুন আপনি আমি আমরা যে কেউ হলে মানসিকভাবে কী অবস্থা হত আমাদের?
আন্দামানের সেলুলার নামক কুখ্যাত জেলের আরও কুখ্যাত এই জেলকুঠুরিতেই ১৯১১ থেকে ১৯২১ টানা ১১ বছর বন্দি ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর।

  • ইনিই বিনায়ক দামোদর সাভারকর, যিনি নাকি মুচলেকা দিয়েছিলেন বলে প্রচার করে বাম ও কংগ্রেসীরা।

ভারতবর্ষের বুকে কোনও বামপন্থী কিংবা কংগ্রেসী নেতা দেশের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে এইভাবে এতবছর এত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জেলবন্দি ছিলেন বলে আমার অন্তত জানা নেই৷

  • সাভারকর যিনি লন্ডনে পড়তে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷ এবং সেখানেও ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন
  • সাভারকর একজন নাস্তিক ছিলেন। জাতিভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন৷ স্ত্রী শিক্ষার জন্য সবসময় এগিয়ে আসার কথা বলতেন সাভারকর৷

*বিপ্লবীদের পিস্তল সরবরাহ ও ব্রিটিশ বিরোদী হিংসাত্মক আন্দোলন প্লযান করার জন্য সাভারকরকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার এবং ১১ বছরেও তাঁকে ছাড়ার সাহস দেখায়নি!

ইতিহাসের পাতায় বামেদের ব্লু আইড বয় হতে গেলে যা যা লাগে তার অনেককটি গুণই ছিল সাভারকরের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আজ দেশের বামেদের চক্ষুশূল এবং বাম-কংগ্রেসীদের লেখা বইয়ে তাঁর মুচলেকা দেওয়ার গল্প ছাড়া আর তেমন কিছুই উল্লেখের প্রয়োজন হয়নি! কিন্তু কেন? কেন বামেদোর ব্লু আইড বয় হতে পারলেন না সাভারকর? কারণ একটাই, ভারতীয় বামপন্থীরা সব সহ্য করতে পারে শুধু একটি জিনিস ছাড়া, সেটা হল হিন্দুদের ও হিন্দুত্ব৷ আর আধুনিক ভারতে এই হিন্দু এবং হিন্দুত্বের কথা বলা তো বটেই আগানীতেও যাতে হিন্দুরা ভারতে
অধিকারিক-সংখ্যালঘু না হয়ে পড়ে কিংবা কথা বলার অধিকার না হারায় তারই ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছেন সাভারকর৷

অতএব তাঁকে নিয়ে বামেরা যে মিথ্য বলবে, তাঁর বিরোধিতা করবে, এ আর নতুন কী! তবে সাভারকর তো সাভারকরই, তিনি যা করে গিয়েছেন দেশের জন্য সেগুলোকে কেউ মুছবে কী করে?

একটা ছোটো ঘটনা দিয়ে এই লেখাটা শেষ করি৷ আমার এক পরিচিত সাংবাদিক যিনি আদর্শগতভাবে কট্টর বামপন্থী কিছুটা র‍্যাডিকালও বটেন৷ তিনি কয়েক বছর আগে আন্দামান গিয়েছিলেন কোনও একটি কাজে৷ সেখান থেকে ফিরে ফোন করে আমাকে বলেছিলেন,

  • কোথাও একটা ভুল হচ্ছে শেখর। নতুন করে অনেক কিছু ভাবার, জানার ও লেখার প্রয়োজন রয়েছে৷ আমি সেলুলার জেলের সাভারকরের বন্দি থাকা কুঠুরিটা দেখে এলাম, কোনও মানুষকে প্রতিদিন মৃত্যুযন্ত্রণা দেওয়া, মরার আগে হাজারবার মারা বোধহয় ব্রিটিশদের পক্ষেই সম্ভব ছিল৷ যে বিপ্লবী ১১ বছর ওই কুঠুরিতে কাটানোর পরও দেশের কথা ভাবে, দেশের হয়ে কাজ করেন তিনি অনন্য, তিনি মহান, তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার আগে আমাদের একশবার ভাবা উচিৎ৷

সময় সময়ের কাজ করবে, কর্ম কর্মের। মিথ্যে দিয়ে আর যাই হোক কর্মকে ঢেকে রাখা যায় না। সাভারকর হোক কিংবা অন্য কেউ। শেষ কথা কোনও প্রোপাগান্ডা নয়, মানুষের কাজই বলবে৷ মথুরার যাদব বাড়ির ছেলেটি সেই কবেই তো বলে গিয়েছেন,

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ‍‍‌ মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।

প্রয়ান দিবসে প্রণাম হে মহারথী সাভারকর।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Sorry! Content is protected !!