Articles

শিব স্বরূপ

© শ্রী সুভাষ চক্রবর্ত্তী

বেদ সংহিতায় যিনি রুদ্র নামে অভিহিত পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতে তিনি দেবাদিদেব শিব বলে পরিচিত। ঋক্-বেদে আমরা
রুদ্রাধ্যায় নামে একটি অধ্যায় পাই। চারবেদের সংহিতায়, ব্রাহ্মণসাহিত্যে ও উপনিষদ গুলিতে ও রুদ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋক্- বেদে রুদ্রকে কখনো মরুৎগণের পিতা, কখনো অগ্নি , আবার কখনো ইন্দ্র অর্থেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কখনো তিনি অতি ভীষণ,উগ্র, সংহারকর্তা, জীবের ভয়-দু:খের কারণ,কখনো রুদ্র জ্ঞান দাতা,সুখদাতা, রোগব্যাধির ঔষধ প্রয়োগকারী বৈদ্যরাজ ।

যজুর্বেদে গিরীশ, গিরিত্র কপর্দী, উগ্র, ভীম, শিতিকণ্ঠ, পশুপতি ইত্যাদি নামে শিব বন্দিত হয়েছেন। কোথাও তিনি
মৃগারোহী, ত্রিশূলধারী।

ঋক্ মন্ত্রে,পুরাণে এবং তন্ত্রে তিনি ঈশান নামেও পরিচিত। সাম বেদে অগ্নিকে যে রুদ্র বলা হয়েছে, তা হল অগ্নির শক্তি। শিব সহস্রচক্ষু, তাঁর বজ্রের বৈদ্যুতিক শক্তি ছিল। ত্রিপুর দহন ও মদনভস্ম রুদ্রের বিদ্যুৎশক্তির দ্বারা সম্ভব। আবার, বৈদিক মন্ত্রে শিবকে ভিষক্-তমম্ বা রোগ ব্যাধির নিরাময়কারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ভৈষজ বলেই তাঁর নাম বৈদ্যনাথ ।

মহাভারতে শিবকে ধন্বন্তরি বা মহাবৈদ্য বলা হয়েছে। ঋক্-বেদে আমরা দেখি নারী রুদ্রের কাছে বংশবৃদ্ধির প্রার্থনা করছেন। আবার ঋক বেদ ও মার্কন্ডেয় পুরাণে প্রাপ্ত মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র অনুযায়ী-
(ওঁ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।)

ত্র্যম্বক অর্থাৎ ত্রিনয়ন বিশিষ্ট মহাদেব জীবকে মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যান। তিনি পঞ্চানন, ত্রিনেত্র, গিরিশ, গিরিতে (কৈলাসে)শয়ন করেন। তার পঞ্চমুখের নাম হল ঈশান, অঘোর, বামদেব, সদ্যোজাত ও তৎপুরুষ। শতপথ ব্রাহ্মণে তাঁর অষ্টমূর্তির নাম রয়েছে কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকে নান্দী শ্লোকে শিবের অষ্টমূর্তির স্তুতির মাধ্যমে কালিদাসের শিবভক্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

পুরাণের যুগে রুদ্র রূপান্তরিত হলেন ত্রিমূর্তিতে – ব্রহ্মা,
বিষ্ণু ও মহেশ্বরে। তিনই একে। একজন জগৎ সৃষ্টি করেন (ব্রহ্মা), একজন পালন করেন(বিষ্ণু) এবং একজন প্রলয় কালে জগৎকে ধ্বংস
করেন (মহাকাল)। কালিকা পুরাণ অনুযায়ী জগৎসৃষ্টির পূর্বে সবকিছু তমোগুণের আবরণে ঢাকা ছিল। শুধু সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় অব্যক্ত জ্ঞানময় এক পরব্রহ্ম সত্তা। এই পরব্রহ্মের জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়াশক্তি রূপান্তরিত হয়ে পরাপ্রকৃতিকে বিক্ষুব্ধ করে জগৎ সৃষ্টি করলেন। সেই সৃষ্টির উর্ধ্বভাগ হল ব্রহ্মার শরীর,মধ্যভাগ হলো বিষ্ণুর
শরীর এবং নিম্নভাগ হলো শিবদেহ। এইভাবে এক পরমতত্ব তিন শরীরে অভিন্ন হয়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন। কালিকাপুরাণে একথা বলা হয়েছে। তিনি স্বয়ম্ভূ, আদ্যন্ত শূণ্য।

পুরাণে শিবকে কপালী বলা হয়েছে। শিব-ব্রহ্মার বিবাদে শিব ব্রহ্মার উপরের পঞ্চম মাথাটি ( প্রথমে ব্রহ্মা চতুর্মুখ নয়, পঞ্চমুখ ছিলেন)
ছিঁড়ে ফেলেন। কিন্তু সেই ছিন্ন মাথা বা কপাল শিবের হাতে
আটকে রইলো। তীর্থে তীর্থে ঘুরেও শিবের হাত থেকে সেই
কপাল যখন খোলা গেল না, তখন কাশীতে এক হ্রদে স্নান
করতেই শিব কপালমুক্ত হলেন। সেই তীর্থের নাম হল কপালমোচন তীর্থ।

শিব হলেন পশুপতি। তাঁর সহচর বৃষভ,নাগ,ভূতপ্রেত,
পিশাচ। জীবের চরম বিশ্রামের স্থান শ্মশান তাঁর বিহারক্ষেত্র । পশুচর্ম(বাঘের চামড়া বা কৃত্তি) তাঁর বসন, রুদ্রাক্ষ তাঁর অলঙ্কার,চিতার ভষ্ম তাঁর অনুলেপ,ত্রিশূল তাঁর অস্ত্র,ডমরু-শিঙ্গা তাঁর
বাদ্যযন্ত্র।

এই পর্যালোচনার পরিক্রমায় শিব জ্যোতির্লিঙ্গে পরিণত হলেন কীভাবে সেই আখ্যানে আসি। একবার ব্রহ্মা- বিষ্ণুর মধ্যে কে বেশি ক্ষমতাবান তা
নিয়ে বিতর্ক বাঁধে। রজোগুণী ব্রহ্মা জগতের ধাতা। আবার বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মা জন্মেছেন। এইভাবে দুজনের যুদ্ধ শুরু হলো প্রলয়-কালীন কারণ সলিলে। যুদ্ধকালে এক
অদ্ভূত সহস্রশিখা,সমুজ্জ্বল , অগ্নিসদৃশ,আভাময় জ্যোতির্ময় লিঙ্গের আবির্ভাব হল। আদ্যন্তশূণ্য অনির্দেশ্য সেই অব্যক্ত,ভাস্বর লিঙ্গ চতুর্দিক
আলো করে আবির্ভূত হলো।

ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই লিঙ্গের উর্ধ্ব ও অধোদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আদি ও অন্ত পেলেন না। তখন তাঁরা সেই লিঙ্গকে প্রণাম করে সামনে দাঁড়াতেই লিঙ্গের ভিতর থেকে গুরুগম্ভীর স্বরে ওম্
(অ-উ-ম্) নাদধ্বনি শুনতে পেলেন এবং দক্ষিণ উত্তর ও মধ্যে অ-উ-ম্ এই তিনটি বর্ণের জ্যোতিদর্শন করলেন।অকারের রং সূর্য মণ্ডলের মত রক্তবর্ণ,উকার এর রং অগ্নিশিখার মত নীলাভ এবং মকারের রং শুদ্ধ স্ফটিকের মত শ্বেতবর্ণ। তখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু মুগ্ধবিষ্ময়ে বৈদিক মন্ত্রে (ওম্ বৃষাকপয়েশর্বায় কর্তে হর্তে নমো নমঃ) এইভাবে লিঙ্গসৃষ্টির সংগে সংগে প্রথম স্তবে পূজিত হলেন। লিঙ্গ হচ্ছে “যত্র বিশ্বং লীনম্ গময়তি স: লিঙ্গ:”।

প্রলয়কালে সমগ্র জগৎ লিঙ্গমধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
আকাশ হচ্ছে লিঙ্গ,পৃথিবী তার যোনিপীঠ । নানা পুরাণে শিবের নানা লীলা করেছেন ।তাঁর বিখ্যাত লীলা হল দক্ষযজ্ঞনাশ। দক্ষের অহঙ্কার ধ্বংস, অসুরদের হাত থেকে স্বর্গরক্ষার জন্য ত্রিপুরাসুরবধ,মদনদহন
(কুমারসম্ভবকাব্যম্) প্রভৃতি।
ভাগবতে শিব সংগীতাচার্য
নটগুরু, চিকিৎসাশাস্ত্রেও
গুরু, চরকসংহিতায় তিনি
বন্দনীয়। যোগশাস্ত্রে তিনি
যোগীশ্বর এবং সংগীতশাস্ত্রে আদি সুরস্রষ্টা নটরাজ। রামায়ণে তিনি রামেশ্বর নামে শিবমূর্তিতে রাম কর্তৃক পূজিত,গঙ্গার মর্ত্যে আগমনে স্বয়ং শিব নিজের জটাজাল থেকে গঙ্গাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। মহাভারতে অর্জুন
জয়দ্রথবধের জন্য শিবের তপস্যা করে পাশুপত অস্ত্র
লাভ করেছিলেন। সমুদ্র- মন্থনে হলাহল কণ্ঠে ধারন করে তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে সমগ্র জীবজগৎকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছিলেন।

ভারতবর্ষে সবচেয়ে ব্যাপক ভাবে পূজিত দেবতা হচ্ছেন শিব কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, পশ্চিম থেকে
পূর্বে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া। উত্তর-পশ্চিমে আফগানিস্তান পর্যন্ত শিবের অবাধ রাজত্ব। শিবের এই বিশাল সাম্রাজ্যে সবচেয়ে ভীত,ক্রুদ্ধ, হিংস্র মুসলিম শাসকরা শিবলিঙ্গের উপর বারবার আঘাত হেনেছে।
পারেনি শিবকে হিন্দুধর্মীয় সাম্রাজ্য থেকে উৎখাত করতে।শিবাবতার ভারত বর্ষে পুণ্যভূমিতে জন্ম নিয়েছেন, বেদান্তশাস্ত্রকে
নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। কিন্তু শৈবধর্মের
গুরু হয়ে। একেবারেই অর্বাচীন কালে শ্রীরামকৃষ্ণসন্তান স্বামী বিবেকানন্দ শিব-অংশ থেকে
জাত। শিবের তেজ থেকে জন্ম নিয়ে তিনি বনের বেদান্তকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন ।

তথ্যসূত্র :—–
১.ঋক্/যজু: বেদের সংহিতা,
ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ।
২.রামায়ণ, মহাভারত
৩.শতপথ ব্রাহ্মণ
৪.কালিকাপুরাণ
৫.ভাগবতপুরাণ
৬.শিবপুরাণ
৭.চরক সংহিতা
৮.অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Sorry! Content is protected !!