Hindu Temples

শ্রী বৈদ্যনাথ

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

এই জ্যোতির্লিঙ্গ ঝাড়খন্ড প্রদেশের সাঁওতাল পরগনা জেলাতে অবস্থিত। এই স্থান অতি প্রাচীন । পুরাণে এই স্থানের উল্লেখ এবং মহিমা বর্ণিত হয়েছে। শাস্ত্র ও লোকসমাজ উভয় ক্ষেত্রেই এই স্থানের প্রসিদ্ধি রয়েছে।
এই জ্যোতির্লিঙ্গের উৎপত্তির ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে লঙ্কাধিপতি রাবণের নাম।

লঙ্কার রাজা রাবণ পরম শিব ভক্ত। তাঁর ইচ্ছা কৈলাস থেকে শিবকে এনে লঙ্কা পুরীতে প্রতিষ্ঠা করবেন। রাবণের কামনা কৈলাসে নয়, অনুরাধাপুরে হবে শিবের নতুন আবাস। কিন্তু শিব যদি রাজি না হন, তাহলে তো তা হবে না! তাই হিমালয়ে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন রাবণ। রোদ, বৃষ্টি ,ঝড়, শীত এবং তুষার অপেক্ষা করে দিনের পর দিন চলল রাবণের তপস্যা।

যজ্ঞকুন্ডে গণগণ করে আগুন জ্বলছে, আর তার পাশে পা উচু করে মাথা নিচু করে শিবের আরাধনা করছেন রাবণ। প্রতিদিন চতুর্দশীর দিনে রাক্ষসরাজ রাবণ নিজের হাতে তাঁর একটি করে মাথা কেটে শিবের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদান করতে শুরু করলেন। একটি করে চতুর্দশী যায় আর একটি করে মাথা কমে যায় দশাননের। ভয়ঙ্কর কঠোর শিব সাধনা কিন্তু শেষ হয়না। দেখতে দেখতে কেটে গেল নটি চতুর্দশী দশানন এর আরেকটি মাথা অবশিষ্ট রয়েছে। দশম চতুর্দশীর দিনে নিজের হাতে সেই মস্তক ছেদন করে আত্মোৎসর্গ করতে গেলেন দশানন।

ভক্তের ভয়ংকর আহবানে আর চুপ থাকতে পারলেন না দেবাদিদেব। রাবণের সামনে প্রকট হলেন তিনি। একটি একটি করে নটি মাথা জুড়ে দিয়ে বললেন:

“হে দশানন তোমার তপস্যায় তৃপ্ত আমি। তুমি বর প্রার্থনা করো”

রাবণ করজোড়ে বললেন:

“হে প্রভু আমি শুধু তোমাকেই চাই । তোমায় লঙ্কাপুরীতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করব। রোজ যেন তোমায় দেখতে পাই: রোজ যেন তোমার পদ যুগল স্পর্শ করতে পারি।”

দেবাদিদেব শংকর রাবণকে ‘তথাস্তু’ বলে আশীর্বাদ করলেন, আর তাঁর বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের একটি তুলে দিলেন রাবণের হাতে। তিনি বললেন:

“এই লিঙ্গ তুমি লঙ্কায় নিয়ে যেতে পারো, কিন্তু যাবার সময় যদি পথে এই লিঙ্গকে কোন স্থানে একবার স্থাপন করো, তাহলে সেই স্থানে লিঙ্গ অচল হয়ে যাবে এবং অনন্ত অনাদি লিঙ্গ রূপে বিরাজ করবে।তুমি আর তাঁকে নিয়ে যেতে পারবে না ।”

অর্থাৎ যাত্রাপথে লিঙ্গ-কে কোথাও ভূমিতে প্রতিস্থাপন করা যাবেনা।

রাক্ষসরাজ রাবণ মাথায় তুলে নিলেন সেই জ্যোতির্লিঙ্গ। আজ তার মনে অখণ্ড আনন্দ। এতদিনে তিনি তার সাধের লঙ্কা পুরীতে প্রতিষ্ঠা করবেন জ্যোতির্লিঙ্গ। তার মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হয়েছে। এই জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠার পরই তিনি শুরু করবেন তার দ্বিতীয় ইচ্ছাপূরণের কাজ – স্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র প্রত্যক্ষ করলেন যে জ্যোতির্লিঙ্গ মাথায় নিয়ে লঙ্কার দিকেএগিয়ে চলেছেন রাবণ। জ্যোতির্লিঙ্গকে লঙ্কায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মহাদেবের বরে অজেয় হয়ে উঠবেন লঙ্কেশ্বর। তারপর দশানন হয়তো ইন্দ্রকে হারিয়ে দখল নেবেন স্বর্গের সিংহাসন। অতএব রাবণকে রুখতেই হবে। তাই দেবরাজ গেলেন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর কাছে। উদ্দেশ্য রাবনকে আটকানোর উপায় অন্বেষণ।

সব শুনে হাসি খেলে গেল ভগবান বিষ্ণুর মুখে। তার নির্দেশ মত ভগবান বরুণ আশ্রয় নিলেন রাবণের পেটে, আর এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ইন্দ্র চললেন রাবণের পিছু পিছু। আত্মমগ্ন রাবণ কিছুই লক্ষ্য করেননি। এগিয়ে চলেছেন তিনি মনের আনন্দে।

হঠাৎই রাবণের পেটে আরম্ভ হল বরুণের প্রচণ্ড চাপ। ধীরে ধীরে সেই চাপ অসহ্য হয়ে উঠল। কিন্তু জ্যোতির্লিঙ্গ মাটিতে রাখার উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন? এই সময় তাঁর দৃষ্টি পরল তাঁর দিকে এগিয়ে আসা সেই ব্রাহ্মণের দিকে। ব্রাহ্মণকে দেখে খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাবণের। রাবণ ব্রাহ্মণ কে বললেন:

“হে ব্রাহ্মণ আপনি কিছুক্ষণ এই শিবলিঙ্গটি ধরে থাকুন। আমি মূত্রত্যাগ করে আসছি।”

রাবণ বসলেন প্রাকৃতিক কর্ম সারতে । কিন্তু ওঠার আর নাম নেই !বরুণের কৃপায় সৃষ্টি হলো কর্মনাশা নদী, কিন্তু তবুও বরুনদেবের নিষ্ক্রমণ আর শেষ হয় না। রাক্ষসরাজ দশানন তখনো উঠতে পারছেন না। এদিকে ব্রাহ্মণ বেশী ইন্দ্রের কাছে ভারী লাগতে শুরু করেছে সেই জ্যোতির্লিঙ্গ। তিনি বললেন যে একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে এই লিঙ্গ বেশিক্ষণ ধরে রাখা অসম্ভব। কিন্তু রাবণের তখনো ওঠার সময় হয়না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে সেই জ্যোতির্লিঙ্গ কে মাটিতে নামিয়ে চলে গেলেন ব্রাহ্মণ রুপী ইন্দ্র। আর ঠিক তখনই শেষ হলো বরুনদেবের নিষ্ক্রমণ।

রাবণ উঠে এসে দেখলেন জ্যোতির্লিঙ্গ মাটিতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তিনি মাটি থেকে শিবলিঙ্গ কে তোলার জন্য চেষ্টাও করলেন। কিন্তু প্রবল চেষ্টার পরেও তিনি সেই জ্যোতির্লিঙ্গকে সেই স্থান থেকে উঠাতে পারলেন না। রাগে অন্ধ রাবণ তখন আঘাত করলেন শিব লিঙ্গের মাথায়। তারপর হতাশ হয়ে চলে গেলেন লঙ্কায়।

রাবণ লঙ্কায় চলে যাবার পরে ব্রহ্মা বিষ্ণু ইত্যাদি দেবগণ সেই স্থানে উপস্থিত হলেন এবং ওই শিবলিঙ্গের পূজা, অর্চনা করলেন।রাবণের এই আঘাতের চিহ্ন জ্যোতির্লিঙ্গ আজও তাঁর মাথায় বহন করে চলেছেন।এগারো আঙ্গুল লম্বা এই জ্যোতির্লিঙ্গ প্রথমে রাবণেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দেবতারা চাইলেন না রাক্ষসরাজ এর সঙ্গে মহাদেবের নাম জড়িয়ে রাখতে। তাঁদেরই জন্য এই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম হল শ্রী বৈদ্যনাথ। শিব সত্য ও সুন্দর। তিনি সর্ব ব্যাধি হরা: রাবণের কর্তিত মস্তক তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন। তাই বৈদ্যদের নাথ বা স্বামী হলেন দেবাদিদেব শংকর। সে কারণেই দেবাদিদেব এর আরেক নাম শ্রী বৈদ্যনাথ।

এই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম অনুসারেই দেওঘরের নাম বৈদ্যনাথ ধাম। যে স্থানে জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির, তার কাছেই রয়েছে এক বিশাল আকৃতির জলাশয়। এই জলাশয় এর নাম শিবগঙ্গা। কোন এক রাজা এই শিবগঙ্গা জলাশয়টি খনন করেন। অসুস্থ মানুষ আরোগ্য কামনায় শিব গঙ্গা তে স্নান করে বৈদ্যনাথ মন্দিরে ধরনা দেন। রাবণ যে স্থানে মূত্র ত্যাগ করেছিলেন সেই হরিতকী বনের এখনকার নাম হরলি জুড়ি। তার উত্তর-পূর্বদিকে কর্মনাশা নদী।

বৈদ্যনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ রীতিমতো প্রশস্ত। এই প্রাঙ্গণে দুটি বড় ও দশটি ছোট মন্দির আছে। প্রধানটি শ্রীবৈদ্যনাথের। অন্যটি জয়দুর্গার। দুটি মন্দিরই ৭২ ফুট উঁচু। গিদ্ধরের রাজা পুরোনমল ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বৈদ্যনাথ মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। দিল্লিতে তখন সম্রাট আকবরের শাসন। আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ছিলেন শিব ভক্ত। তিনি এই মন্দিরের কাছে এসে প্রায়ই তাঁবু খাটিয়ে থাকতেন। যুদ্ধের পূর্বে তিনি বৈদ্যনাথের পূজা দিয়ে যেতেন। মানসিংহ শিব গঙ্গার ঘাট বাঁধিয়ে দেন, আর মানসর নামে একটি জলাশয় খনন করেন।

পাল রাজাদের রাজত্বের সময় এখানে উত্তানিয়ের নামে একটি বড় বৌদ্ধ বিহার ছিল। বহু শ্রমন-এর বাস ছিল এই বিহারে। কিন্তু বড় জল কষ্ট ছিল সেখানে। সেই কষ্ট নিবারণ করবার জন্য রাজা ধর্মপাল একটি জলাশয় খনন করেছিলেন।

দেওঘর বড় পবিত্র স্থান। জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে পবিত্র তপোবন পাহাড়, ত্রিকুট পাহাড়। তপোবন পাহাড় জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির থেকে মাইল চারেক দূরে অবস্থিত ছোট্ট একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের এক গুহাতে বসে দীর্ঘদিন তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন শ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারী। শোনা যায় রাক্ষসরাজ রাবণও নাকি এই পাহাড়েই তপস্যা করেছিলেন। এই পাহাড়ের পাশেই রয়েছে শূলকুণ্ড নামে একটি ছোট কুণ্ড আর কুন্ডেশ্বরীর প্রাচীন মন্দির। ত্রিকুট পাহাড় সম্পর্কে প্রবাদ আছে যে বনবাসের পথে শ্রীরাম – সীতার পদধূলি পড়েছিল এই পাহাড়ে।

শ্রী বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ অনন্ত ফল প্রদানকারী। সারাবছর বাবার মন্দিরে ভিড় লেগে থাকে। তবে ভাদ্র পূর্ণিমা, শিবরাত্রি আর শ্রীপঞ্চমীর দিন ভক্তরা বিশেষভাবে আসেন জ্যোতির্লিঙ্গের মাথায় জল ঢালতে । অনেকে মুঙ্গেরে গঙ্গা থেকে জল নিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে আসেন শ্রী বৈদ্যনাথ এর মাথায় জল দিতে। পুরাণ অনুযায়ী যে এই জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করে তার সকল পাপ ও রোগের মুক্তি ঘটে। যিনি এই জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করেন দেবাদিদেবের কৃপা তাঁর উপর সর্বদা বজায় থাকে। দৈহিক, দৈবিক , করা কোন প্রকার কষ্টই তার কাছে আসে না। তিনি পরম শান্তিদায়ক শিবধাম লাভ করেন। তাঁর সকল কাজই ভগবান শিবকে সমর্পিত রূপে করা হয়ে থাকে।তিনি সমস্ত বিশ্বে ভগবান শিবের রূপ দর্শন করে থাকেন। সকল ভেদেই তিনি অভেদ দৃষ্টি দিয়ে দেখেন: কোন প্রাণীর প্রতি ঈর্ষা বা দ্বেষ, ঘৃণা বা বৈরিতা থাকেনা। এইরূপ ভক্ত সদাই মানুষের কল্যাণে ও হিতে ব্যাপ্ত থাকেন। ভগবান শিবের ভক্তির এই অমোঘ ফল সকল সনাতনীর প্রাপ্ত করা উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Sorry! Content is protected !!