© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
ভারত স্বাধীন হয় 1947 খ্রিস্টাব্দের 15 আগস্ট। কিন্তু তখনো ভারতের যে ভূখন্ড আজকে আমরা দেখছি, তার পুরোটা ভারতের সীমানার অধীনে ছিল না। ইংরেজরা যখন ভারত ছেড়ে যায়, তখন 565টি দেশীয় রাজ্য ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই রাজ্যগুলিতে পৃথক রাজা ছিল এবং সেইসব রাজারা ব্রিটিশের অনুগত হলেও সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের সীমানার অন্তর্ভুক্ত ছিল না । স্বাধীনতার আগেই এইসব দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আবেদন জানানো হয়। বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যের রাজাই ভারতীয় ঐতিহ্য ও পরম্পরা মেনেই রাজ্য শাসন করতেন। তাঁরা নিজেদের ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করতেন না, তাই সেইসব রাজারা এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ইন্সট্রুমেন্ট অফ একসেসন ( Instrument of Accession) আইনে স্বাক্ষর করে নিজেদের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। এইসব রাজ্যগুলিকে বোঝানোর পেছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারতের প্রথম গৃহমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং তাঁর সচিব শ্রী ভি. পি. মেনন। কিন্তু কয়েকজন শাসক ছিলেন যাঁরা এত সহজে ভারতে যোগদান করেননি। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলী খান ।
1947 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসেই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ঘোষণা করেন যে যদি কোন রাজ্য সহযোগিতা করতে নারাজ হয়, তখন বিকল্প হিসেবে নৈরাজ্যের কথা ভাবা যাবে। হায়দ্রাবাদ কিন্তু তাতেও নিজেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে রাখার ইচ্ছা ত্যাগ করেনি। এরপরেও এক বছরের কিছু বেশী সময় ধরে হায়দ্রাবাদের নিজাম এবং ভারত সরকারের মধ্যে হায়দরাবাদ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতে থাকে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে হায়দ্রাবাদ রাজ্য ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হায়দ্রাবাদ রাজ্য ছিল উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম। তাই সর্দার প্যাটেল হায়দ্রাবাদ সমস্যাকে
‘ a cancer in the belly of India ‘ ( ভারতের পেটের কর্কট রোগ) বলে অভিহিত করেছিলেন।
হায়দ্রাবাদের মধ্যেও তিন ধরনের রাজনৈতিক মতামতের অস্তিত্ব ছিল। একপক্ষ ছিলেন নিজাম যিনি হায়দ্রাবাদের শাসক। তিনি চাইছিলেন হায়দ্রাবাদকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাখার। নিজামের অন্যতম সমর্থনকারী রাজনৈতিক দল ছিল ইত্তেহাদ- উল- মুসলিমেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই দলটি এখনো ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয়। এই দলের অন্যতম দুই সাংসদ হলেন আসাদুদ্দিন ওবেশী এবং তার ভাই আকবর উদ্দিন ওবেশী। সেই সময় এই দলটির সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতেন যাঁরা তাঁদেরকে রাজাকার বলা হত। রাজাকাররা চেয়েছিল হায়দ্রাবাদকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করতে। হায়দ্রাবাদের ভারতে অন্তর্ভুক্তিকরণ এর সমর্থক ছিল হায়দ্রাবাদ স্টেট কংগ্রেস দল। আর এক পক্ষ ছিল কমিউনিস্ট পার্টি যারা হায়দ্রাবাদকে কমিউনিস্ট রাজ্য বানানোর পক্ষপাতী ছিল। এমত অবস্থায় 1947 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে নিজাম ভারত সরকারের সঙ্গে স্ট্যান্ড স্টিল এগ্রিমেন্ট ( Standstill Agreement) সই করে কিছুদিনের জন্য স্থিতবস্থা বজায় রাখতে চান।
এই অবস্থায় সময় এগিয়ে চলে কিন্তু হায়দ্রাবাদের নিজাম কোন ধরনের স্থায়ী সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। ফলাফল স্বরূপ রাজাকারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে লাগল আর হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও চলতে লাগল। দেশবিরোধী কমিউনিস্টরা এই সুযোগে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা আরম্ভ করল। 1948 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ছেড়ে চলে গেলেন এবং শেষবারের মত নিজামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবার আহ্বান জানালেন। কিন্তু ফলাফল কিছুই হল না। এই অবস্থায় সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল হায়দ্রাবাদে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
অবশেষে ভারতীয় সৈন্য হায়দ্রাবাদ পৌঁছল এবং মাত্র চার দিনের মধ্যে হায়দ্রাবাদ ভারতের দখলে এল। ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর এই কার্যক্রম অপারেশন পোলো নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রায় 42 জন ভারতীয় সেনা এবং প্রায় 2000 রাজাকার বীরগতি প্রাপ্ত হয়। যুদ্ধের সময় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাতেও প্রায় দু লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। অবশেষে 17 সেপ্টেম্বর নিজাম ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই যুদ্ধে ভারতের হয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল শ্রী জয়ন্ত নাথ চৌধুরী । তাঁর ঠাকুমা সুকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নী, আর তাঁর মা পরিমলা দেবী ছিলেন উমেশচন্দ্র ব্যানার্জির কন্যা। যাই হোক 18 সেপ্টেম্বর, 1948 নিজাম যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন এবং দাবি করেন রাজাকাররা তাঁকে চাপ দিচ্ছিল যাতে করে হায়দ্রাবাদকে স্বাধীন রাখা যায়। যুদ্ধে হারের পর তিনি রাজাকারদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং 1948 খ্রিস্টাব্দের 18 সেপ্টম্বর হায়দ্রাবাদ রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি অন্তর্ভুক্তিকরণের বিশদ ইতিহাস খুব কম মানুষেরই জানা আছে। এই ইতিহাস আমাদের কাছে খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ এই ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি ভারত গঠনে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের অবদানের কথা : বুঝতে পারি কেন কোটি কোটি অর্থ রাশি খরচ করে তাঁর মূর্তি – statue of unity নির্মাণ করেছে ভারত সরকার। সেই সঙ্গে এটাও আমরা জানতে পারি কারা সেই সময় নিজাম কে ভারত বিরোধীতার পথে চালিত করেছিল : কারা নিজামের দুর্বলতার সুযোগে হায়দ্রাবাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছিল । যারা নিজামকে ভারত বিরোধিতার পথে চালিত করেছিল, সেই রাজাকারদের উত্তর পুরুষ হলেন আসাদউদ্দিন ওবেশী এবং তাঁর দলবল। আর যাঁরা সেদিন হায়দ্রাবাদে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিলেন তাঁরা হলেন কমিউনিস্ট। এই দুই দল তাদের ঐতিহ্য মেনে আজও ভারত বিরোধীতাতে সামিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় এটাই যে হায়দ্রাবাদ স্টেট কংগ্রেস দল যারা চেয়েছিল হায়দ্রাবাদকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করতে তাদের উত্তর প্রজন্ম তথা সর্দার প্যাটেলের দল জাতীয় কংগ্রেস আজ দেশবিরোধী ইত্তেহাদ – উল – মুসলিমেন এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত বিরোধিতায় সামিল হয়েছে। এটা সমগ্র জাতির কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।