১৪ জুলাই ২০২১ সালে নিঃশব্দে পার হয়ে গেল বাজি প্রভু দেশপান্ডের ৩৬১তম পুণ্যতিথি (মৃত্যুবার্ষিকী)। মারাঠিরা দেশপান্ডেকে সর্বকালের সেরা মারাঠা বীর মনে করে, কিছু জায়গায় এমনকি দেশপান্ডেকে শিবাজির চেয়েও বড় বীর মনে করা হয়। ইনি শিবাজিকে বাঁচাতে নিজের জীবন দান করেছিলেন।
পবনখিন্দের যুদ্ধে দেশপান্ডের ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। এই যুদ্ধ চলাকালীন শিবাজি পানহালা দুর্গ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তিনি পরবর্তী কালে ছত্রপতি হতে পেরেছিলেন। রাজাকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন দেশপান্ডে, নিজের জীবনের বিনিময়ে।
পবনখিন্দের যুদ্ধ, ১৩ জুলাই ১৬৬০
আজকের মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের বিশালগড় দুর্গে পবনখিন্দের বিখ্যাত যুদ্ধ হয়েছিল। আদিলশাহি সেনাবাহিনীর সাথে মারাঠাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মারাঠা দেশপান্ডে ও আদিলশাহি মাসুদ মহম্মদ।
শিবাজি আফজল খানকে পরাজিত করার পাশাপাশি বিজাপুরের সুলতানিয়তের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার পর বিজাপুর রাজ্যের একেবারে ভেতরে ঢুকে পরেছিল। এই সময়েই তিনি পানহালা দুর্গ জয় করে নেন। শিবাজিকে সাহায্য করতে মারাঠা সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ভরসা নেতাজি পালকার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন।
কিন্তু বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ আগে থেকে গুপ্তচর মারফত জানতে পেরেছিলেন এরকম কিছু হবে, তাই তিনি বিজাপুরী সেনাবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। বিজাপুরী সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের জেরে মারাঠা সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয় এবং শিবাজি কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা আধিকারিককে হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন।
বিজাপুরী সেনাবাহিনীর এই পাল্টা আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্ধি জোহার, জাতে তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ার (আজকের ইথিওপিয়া) মানুষ। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন পুরো মারাঠা সেনাবাহিনী পানহালা দুর্গে বন্দি হয়ে আছে। তিনি দুর্গ অবরোধের নির্দেশ দেন বিজাপুরী সেনাবাহিনীকে। নেতাজি পালকার অনেক চেষ্টা করেও অবরোধ ভাঙতে ব্যর্থ হন।
বিজাপুরী অবরোধ কিভাবে ভাঙ্গা যায়?
অবরোধ ভাঙতে নেতাজি পালকারের বাহিনীর অসাফল্য দেখে শিবাজি গভীর চিন্তায় পড়ে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সদলবলে পানহালা দুর্গ থেকে বেরতে না পারলে এখানেই তার ভারত জয়ের স্বপ্ন শেষ হবে। এই সময়ে প্রভু দেশপান্ডে তাকে আশ্বাসন দেন তিনি কয়েকজন মারাঠা সৈনিক নিয়ে বিজাপুরী অবরোধ ভাঙবার চেষ্টা করবেন।
এই সময়ে বিজাপুরী অবরোধ ভাঙবার জন্য যিনি দেশপান্ডের পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তার নাম শিবা নহাভি। তার সাথে শিবাজির দৈহিক সাদৃশ্য ছিল বিস্ময়কর রকম। এমনকি শিবাজি মাঝেমধ্যেই তাকেই শিবাজি সাজিয়ে নিজে মারাঠা সাম্রাজ্য ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করতেন। নহাভি স্থির করেছিলেন, এবারেও শিবাজি সেজে বিজাপুরীদের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেবেন এবং এই সুযোগে তিনি শিবাজিকে পালাবার সুযোগ করে দেবেন।
পরিকল্পনা অনুসারে গুরু পূর্ণিমার দিনকেই বেছে নেওয়া হয় দুঃসাহসী অভিযানের জন্য। বাজি প্রভু দেশপান্ডে মাত্র ৬০০ সৈন্য নিয়ে ‘অ্যাকশনে’ নেমে পড়েন। দেশপান্ডে জানতেন বিজাপুরী সেনাবাহিনীকে রোখার কাজ মোটেও সহজ হবে না। তাই তিনি পরিকল্পনা সফল করার উদ্দেশ্যে শিবা নহাভিকে কয়েকজনের সাথে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেন। এতে মারাঠা সেনাবাহিনী কিছু বাড়তি সময় পায় পানহালা দুর্গ থেকে পালাবার জন্য।
প্রায় দুই ঘণ্টা বাদে সিদ্ধি জোহার বুঝতে পারেন তিনি যাকে ধরে এনেছেন, তিনি আদৌ শিবাজি নন, তার ছদ্মবেশে থাকা নহাভি মাত্র। এরপরই তিনি সদলবলে আবার পানহালা দুর্গে রওয়ানা দেন। এবার মাসুদ জোহার, সিদ্ধির জামাতা দুর্গ অবরোধ করার নেতৃত্ব দিতে থাকেন। সে সময়ে দেশপান্ডে ঘোড়কিন্দ (অশ্বক্ষুরাকৃতির গিরিখাত) স্থানে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত লড়াই দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তার সাথে সহোদর ভ্রাতা ফুলজিও ছিলেন।
বাজি প্রভু দেশপান্ডের শেষ লড়াই এবং শিবাজির পলায়ন
এইবার আসছি মারাঠা ইতিহাসের সবচেয়ে কম শোনা অথচ সবচেয়ে কঠিনতম, দুঃসাহসে ভরপুর অধ্যায়ে। যেখানে মাত্র ৬০০ সৈন্য নিয়ে ৬০০০০ সৈন্যের সাথে মুখোমুখি লড়াই করা যেতে পারে। ১৮ ঘণ্টা ধরে চলা এই যুদ্ধ অবিশ্বাস্য রণনীতি ও সাহসের নমুনা।
দেশপান্ডে জানতেন প্রায় ১০০ গুন বড় সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে আলাদা পরিকল্পনা ও সাহসে প্রয়োজন। তিনি ও তার সহযোগীরা দুহাতে তলওয়ার ধরে ১৮ ঘণ্টা বিনা আহারে, বিনা জলপান করে, লড়ে যেতে থাকেন। বিজাপুরীরা ভাবতেই পারেনি, তারা এমন প্রতিরোধের মুখে পড়বে। ধুরন্ধর দেশপান্ডে ও তার সহযোগীরা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন কয়েকজন ধৃত আহত বিজাপুরী সৈনিককে, ফলে স্বজাতিতে মারতে বিজাপুরীরা ধর্মসঙ্কটে পড়েছিল। তাদের এই দ্বিধাগ্রস্ততার সুযোগে দেশপান্ডে ও তার সহযোগীরা নির্বিচারে বিজাপুরীদের কচুকাটা করতে থাকে।
এইভাবে আঠারো ঘণ্টা ধরে ৬০১ মারাঠা সৈনিক লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। এই সুযোগে শিবাজি তার দলবল নিয়ে বিশালগড় পালাতে সক্ষম হন, সেখান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অবশেষে দেশপান্ডে ভ্রাতৃদ্বয়কে পরাস্ত ও নিহত করে যখন পানহালা দুর্গে বিজাপুরীরা ঢুকে পড়ে, তখন দেখতে পায়, শিবাজি ও তার সহযোগীরা আগেই পালিয়ে গিয়েছে।
বিশালগড় পৌঁছানো শিবাজিদের কাছে মোটেও সহজ কাজ ছিল না। তাদের যাত্রাপথের মধ্যে পড়েছিল দুই মারাঠা বংশোদ্ভূত বিজাপুরী সেনাপতি দলভি ভ্রাতৃদ্বয় সূর্যরাও ও যশবন্তরাও। কিন্তু তাদের পরাস্ত করে ৩০০ সৈনিক নিয়ে শিবাজি অবশেষে বিশালগড় হয়ে শেষে মারাঠা রাজ্যে পৌঁছে যান।
মারাঠা দেশপ্রেমের অন্যতম প্রতীক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছে দেশপান্ডে ভ্রাতৃদ্বয়। তাদের এমন বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ছাড়া শিবাজি পানহালা থেকে পালাতে পারতেন না। ফলে মারাঠা সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্নও ব্যর্থ হত। এখানেই দেশপান্ডের গুরুত্ব।