© সূর্য শেখর হালদার
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের নাম শোনা হয়নি , এমন বাঙালি মনে হয় নেই। এই মেঘনাদ বধ কাব্য লেখা হয় 1861 সালে, ঠিক যে বৎসর জন্ম গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে রাখতে হবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং একজন ধর্ম পরিবর্তন কারী। সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মাইকেল নাম নেন। এখন কারো মনে হতে পারে একজন বিখ্যাত কবির ধর্ম নিয়ে লেখালিখি কেন ? কবি তো সর্বজনীন: সমস্ত জাতি, ধর্মের উর্ধ্বে। কিন্তু কোন কবির সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে তিনি তাঁর জাতি বা ধর্মের বোধ থেকে মুক্ত হতে পারেন না। শেকসপিয়র এ মত কবিও ( নাটক গুলি কাব্যের ভাষায় লেখা তাই তাঁকে কবি বলা যায় ) তাঁর জাতি, ধর্মের উপরে উঠতে পারেন নি। তাই তিনি The Merchant of Venice এর মত নাটক লিখেছিলেন যেখানে ভিলেন বানিয়েছিলেন সাইলক নামের এক ইহুদিকে। এই নাটকে শেকসপিয়র বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন শাইলকের ধর্ম পরিচয়। কারণ শাইলক ছিল ইহুদি অথচ অন্য চরিত্রদের ( খ্রিস্টান ) ধর্মের উপর এত জোর তিনি দেন নি। এখন আসুন দেখা যাক মাইকেল মধুসূদন তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্যতে এইরূপ কি কিছু করেছিলেন ?
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের নায়ক হলেন মেঘনাদ। তিনি এই কাব্যে দেখাতে চেয়েছেন যে মেঘনাদ একজন পিতৃভক্ত এবং দেশপ্রেমিক। তিনি বহিরাগত রামের বিরুদ্ধে দেশকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছেন। রাম এসেছেন সাগর পেরিয়ে লঙ্কাতে লঙ্কা দখল করতে। আর বিভীষণ একজন দেশদ্রোহী যিনি নিজের গৃহ পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন একজন বনবাসী তস্করকে ( রাম ) ।
এখন প্রশ্ন হল রাম, যিনি হাজার হাজার বছর ধরে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়াতে আরাধ্য, তাঁকে ছোট করে মেঘনাদ এবং রাবণ কে বড় করে দেখানোর কারণ কি ? রাবণ অপহরণ করেছিলেন সীতাকে। সে কারণেই রাম লঙ্কা আক্রমণ করেন। রাম কোন দেশ দখলের উদ্দেশ্যে নিয়ে এই কাজ তো করেন নি। আর রাবণ যদি রাষ্ট্রহিত চাইতেন তাহলে নিজের কাম চরিতার্থ করার জন্য সীতাকে আটকে রেখে দিয়ে তাঁকে বিবাহ করার জন্য তাঁর উপর মানসিক নিপীড়ন করতেন না । তাই রাবণ আদৌ দেশপ্রেমী না আর মেঘনাদ পিতৃ ভক্ত হলেও পিতার অন্যায়ের সমর্থনকারী। তাহলে এহেন মেঘনাদ আর রাবণ কে বড় করে দেখানো কি শুধুই সনাতন হিন্দু ধর্মের এক অন্যতম আইকনকে অপমান করার জন্য ? যিনি স্বীয় ধর্ম , সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আপন করে নেন, তাঁর থেকে এটা খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। যদিও মাইকেলের রামায়ণ নামক কবিতাটি কবিকে রাম বিরোধী বলে প্রমাণ করে না। অর্থাৎ তাঁর মনের মধ্যে রাম সম্পর্কে একটা স্ব বিরোধিতা হয়তো বর্তমান ছিল।
স্বাধীন ভারতে অবশ্য এই ধরনের কাব্যের প্রশংসা হবার কথা নয়। কাব্য গুনের কথা ধরতে গেলে মেঘনাদবধ কাব্য নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন, কিন্তু বিষয় কখনোই নৈতিক ভাবে সমর্থন যোগ্য নয়। এখন ছদ্ম সেক্যুলার সাহিত্য সমালোচক গণ এটা বুঝতে পেরে মেঘনাদবধ কাব্য সমালোচনাকে একটা নতুন মাত্রা দেন। এইসব সেক্যুলার এবং মার্কসবাদী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলা সাহিত্যের সমালোচকরা বলেন যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা যেমন সমুদ্র পেরিয়ে ভারত আক্রমণ করেছিল, রামও সেই রকম সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করেন। অতএব ইংরেজের মত রাম বহিরাগত। আর রাবণ হলেন সেইসব দেশীয় রাজাদের মত যাঁরা ইংরেজের সাম্রাজ্য বিস্তারে বাধা প্রদান করেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইতে শহীদ হন ! এটাকে তাঁরা মেঘনাথ বধ কাব্যের উত্তর-ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যা বলে প্রচার করেন। এই ব্যাখ্যাও রামকে বহিরাগত এবং অন্যায়কারী বলে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। আর এই ব্যাখ্যা সহ মেঘনাদ বধ কাব্যের কিয়দংশ পড়ানো হয় পশ্চিম বঙ্গের সরকারি বিদ্যালয়তে। এর ফলে কিশোর অবস্থাতেই একটি বাঙালি হিন্দু ছাত্র / ছাত্রী রামকে তস্কর, আক্রমনকারী, অন্যায়কারী রূপে ভাবতে আরম্ভ করে।
পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় সিলেবাসে এই ধরণের বহু ষড়যন্ত্র বা কারসাজি রয়েছে যাতে করে বাঙালি হিন্দু সন্তান ছোট বেলা থেকেই নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঘৃণা উদ্রেক করতে থাকে। তাহলে কি মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ানো উচিত নয় ? অবশ্য উচিত কারণ বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ন কাব্য, কিন্তু বিষয় সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন দরকার। এটা ছোট ছাত্র / ছাত্রীদের জানানো প্রয়োজন যে রামায়ণের বহু ঘটনাকে এই কাব্যে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মেঘনাদ বধের দৃশ্যের বর্ণনাও মূল বাল্মীকি রামায়ণের থেকে পৃথক। কবি মাইকেল মধুসূদন ইংরেজ কবি মিল্টনের Paradise Lost নামক মহাকাব্যের অনুসরণে এই কাব্য রচনা করেন। কিন্তু মিল্টন তাঁর কাব্যে কোনভাবেই খ্রিস্টান God কে ছোট দেখান নি : সেখানে Satan ( God এর প্রতিপক্ষ ) এর মহিমা God এর মহিমাকে ছাপিয়ে যায় নি। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন এর ক্ষেত্রে মেঘনাদ এর মহিমা শ্রীরামের মহিমাকে ছাপিয়ে গেছে মেঘনাদ বধ কাব্যে। সমকালীন সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে হয় নি সেটা নয়। কিন্তু সমালোচক দের লেখনী মাইকেলের মত শক্তিশালী ছিল না । তাছাড়া তথাকথিত রেনেশা বা পাশ্চাত্য চিন্তার জয়গানে বিভোর তৎকালীন হিন্দু বাঙালি সমাজ সেই সমালোচনাকে গ্রহণ করে নি। আর বর্তমান বাঙালি সমাজ তো মেঘনাদ বধ কাব্য কে প্রকৃত রামায়ণ ধরে বসে আছেন।
এখন বাঙালি হিন্দু পাঠক ভাবুন এটাকেই কি চলতে দেবেন নাকি এই ধরনের ষড়যন্ত্র বিনষ্ট করবেন ?