© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
পুরাণ অনুযায়ী ভারতবর্ষে মোট সাতটি পবিত্র নদী রয়েছে। এগুলি হল গঙ্গা,
যমুনা,সরস্বতী, গোদাবরী, কাবেরী, সিন্ধু ও নর্মদা। এই নর্মদা নদীর জন্ম কথা বর্ণিত হয়েছে পুরাণে। নর্মদা নদীর উৎপত্তিস্থল হল বিন্ধ্য পর্বতের অমরকন্টক শৃঙ্গ। দক্ষিণ ভারতীয় নদীগুলির মধ্যে নর্মদা হল পশ্চিম বাহিনী নদী। প্রায় ৮১৩ মাইল লম্বা নর্মদা তার গতিপথের শেষে নিজেকে সঁপে দিয়েছে কাম্বে উপসাগরে। এই স্থানটি হল সুরাটের নিকটবর্তী বারোচ।
ভারতীয় সংস্কৃতি প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা ও পূজা করতে শেখায়।তাই এই দেশে নদী শুধুমাত্রই জলধারা নয় : নদী হলো দেবী। সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মেনেই নর্মদা নদী হয়ে উঠেছে দেবী নর্মদা যিনি আমাদের পূজ্য। পুরাণে কথিত আছে
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষে শিব চতুর্দশী তিথি হল দেবী নর্মদার জন্মতিথি । নর্মদা মন্দিরের বর্ণনার পূর্বে আমরা জেনে নিতে পারি দেবী নর্মদার জন্ম আর পবিত্রতা অর্জনের কাহিনী।
একবার দেবাদিদেব মহাদেব গভীর অরণ্য বেষ্টিত নিভৃত পর্বত শিখরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। কতকাল যে তিনি ওই ভাবে ছিলেন তার কোনো হিসাব নেই। হঠাৎ একদিন শিব কন্ঠ থেকে নির্গত হলেন দেবী নর্মদা। আবির্ভাব এর পরেই তিনি মহাদেবের দক্ষিণ চরণের উপর দাঁড়িয়ে শুরু করলেন তপস্যা। সেই তপস্যা চলল দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন ধ্যানভঙ্গ হল মহাদেবের।
চোখ মেলেই তিনি দেখলেন এক অপূর্ব সুন্দরী কুমারী কন্যা তাঁর অঙ্গ স্পর্শ করে আছে। সেই সুন্দরী কন্যা ধ্যানমগ্না। দেবাদিদেব সেই কন্যার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে, কন্যা জানালো,
“আমি আপনার নীলকন্ঠ নিঃসৃতা কন্যা, নর্মদা।”
দেবাদিদেব বললেন,
“কন্যা, তোমার তপস্যায় আমি প্রীত। তুমি বর প্রার্থনা করো।”
অমৃত মন্থন এ উত্থিত হলাহল পান করে মহাদেব হয়েছিলেন নীলকন্ঠ। সেই নীলকন্ঠ থেকেই নিঃসৃত নর্মদা। তিনি আর কি বর চাইবেন?
নর্মদা বললেন,
” আপনি আমাকে এমন বর দিন যাতে আমি গঙ্গার মত পুণ্যতোয়া হই। আমার শরীরে স্নান করলে মানুষ যেন সর্ব পাপ মুক্ত হয়। “
মহাদেব হাত তুলে বললেন, “তাই হবে, গঙ্গায় স্নান করলে যে ফল হয়, সেই একই ফল মানুষ পাবে শুধু তোমায় দর্শন করলে। আর কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর কাটলে, গঙ্গার মাহাত্ম্য নষ্ট হবে, তখন তুমি গঙ্গার সমস্ত মাহাত্ম্য লাভ করবে।”
এভাবেই পবিত্রতা অর্জন করলেন দেবী নর্মদা। দেবী নর্মদার উৎপত্তিস্থল হল অমরকন্টক পর্বত। কবি কালিদাসের বিখ্যাত মেঘদূতম্ কাব্যে আমরা পাই অমরকন্টক এর সৌন্দর্যের বর্ণনা। কাব্যে আম্র বৃক্ষ সুসজ্জিত অমরকন্টকের বর্ণনা বার্তাবাহক মেঘকে দিয়েছিল বিরহী যক্ষ। আজকের অমরকন্টক ঠিক একই রকম সুন্দর আর আম্র বৃক্ষ পরিপূর্ণ। দেবী নর্মদার উৎস স্থল এবং মন্দির পৌঁছতে গেলে অমরকন্টকের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠতে হবে ৪৫ কিলোমিটার। উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ ফুট। উৎস স্থল এর প্রবেশ স্থানে রয়েছে একটি বিশাল তোরণ। এই তোরণের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যাবে অনেকটা স্থান জুড়ে পাথর বাঁধানো চত্বর। এই চত্বর দিয়ে একটু এগোলেই দেখা যাবে দেবাদিদেব মহাদেবের মানস কন্যা নর্মদাকে। যে স্থানে নর্মদার প্রথম উদ্গম সেই
স্থানটির নাম হল নর্মদা কুণ্ড। নর্মদা কুণ্ড চারিদিকে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা । শত শত বছর ধরে কুন্ডে যে জল উঠে আসছে, সেই জল বেরোনোর জন্য রয়েছে একটি নালার সংযোগ। এই নালার নাম গোমুখ নালা। এই নালা অতিক্রম করে নর্মদা এসে পড়েছে কোটি তীর্থে। এই কোটি তীর্থ হল এগারো কোন বিশিষ্ট আরো একটি কুণ্ড। যেসকল সাধু-সন্ন্যাসী নর্মদা পরিক্রমাতে আসেন তাঁদের এই কোটি তীর্থের জলেই সংকল্প করতে হয়।
নর্মদার উৎস মুখের উপরেই নির্মিত হয়েছে দেবী মন্দির। মন্দিরে স্থাপিত কষ্টি পাথরের দেবী নর্মদার কালো মূর্তি। দেবীর একহাতে বরাভয় অন্যহাতে কমন্ডলু। উচ্চতায় প্রায় তিন ফুট।
দেবী নর্মদা আর মহাদেবের সম্পর্ক পিতা ও কন্যার। তাই দেবী নর্মদার মন্দিরের পাশেই রয়েছেন মহাদেব। এখানে মহাদেবের নাম অমরকন্টকেশ্বর।
এককালে নর্মদা কুন্ডের অবস্থান ক্ষেত্রে ছিল বেণু বা বাঁশ বন। তাই এখানে মহাদেবের আরেকটি নাম বেণেশ্বর। ১২২৯ সালে ইন্দোরের রাজা নর্মদা মন্দিরের সংস্কার করেন। ১২৩৯ সালে রেওয়ার রাজা তোরণটি নির্মাণ করান। কথিত আছে নর্মদার উৎসমুখের প্রথম সন্ধান পান মারাঠা রাজ প্রথম বাজিরাও। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে এই তীর্থ। আর গভীর অরণ্য ও পাহাড় বেষ্টিত অমরকন্টক নগরী প্রতিষ্ঠা করেন ভোঁসলে রাজারা। এখানে যে যাত্রীনিবাস রয়েছে সেটি তৈরি করিয়ে দেন মহারানী অহল্যা বাঈ ।
নর্মদা মন্দির চত্বর ছেড়ে এগিয়ে এলেই একটু দূরে দেখতে পাওয়া যায় পাতালেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটি বহুকালের প্রাচীন এবং প্রায় অন্ধকার। আবছা অন্ধকারে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে এলে হাত পাঁচ – ছয় নীচে গর্তের মধ্যে অবস্থান করছেন পাতালেশ্বর মহাদেব। গর্ভগৃহের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নর্মদা কুন্ডের। তাই অনেক সময় পাতালেশ্বর ঢাকা পড়ে যান কন্যা নর্মদার জলে ।
পাতালেশ্বর মন্দির থেকে নির্জন, কোলাহলহীন , মনোহর, গেরুয়া পথ ধরে খানিক দুর এগোলেই দেখতে পাওয়া যায় মৎস্যেন্দ্রনাথ মন্দির। মৎস্যেন্দ্রনাথ হলেন নাথ সম্প্রদায়ের মহাযোগী গোরক্ষনাথ এর গুরু। কথিত আছে তিনি এই স্থানেই কঠোর তপস্যারত হয়েছিলেন। তাই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর মন্দির।
এই স্থান থেকে চড়াই-উৎরাই ধরে আর একটু এগোলেই দেখতে পাওয়া যায় কর্ণ মন্দির। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় সভায় উপস্থিত ছিলেন কর্ণ। মহারথী, মহাজ্ঞানী হয়েও তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি এই নির্লজ্জ ঘটনার। তাই পাপবিদ্ধ হন তিনি। কথিত আছে এই পাপ মুক্ত হবার জন্য তিনি অমরকন্টকের এই স্থানে তপস্যা করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতেই তৈরি এই মন্দির। এই মন্দিরের নিকটেই রয়েছে একটি কমণ্ডলুর মত দেখতে পাহাড়ের গুহা মুখ। কথিত আছে এইখানে বসেই তপস্যা করেছিলেন মহর্ষি ভৃগু । তাই এই ক্ষেত্রটির নাম
ভৃগুকমণ্ডলু।
দেবী নর্মদার উৎস স্থলে তপস্যা করেছিলেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়। মহাভারতের বনপর্বতে আছে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নর্মদা তীর্থে এসেছিলেন পুরোহিত ধৌম্যের পরামর্শে। তখন তিনি ঋষি মার্কণ্ডেয়র মুখ থেকে শ্রবণ করেছিলেন নর্মদা তীর্থের মাহাত্ম্য কথা। মহর্ষি
মার্কণ্ডেয়র এই তপস্যা ভূমিতে আজও অবস্থিত মার্কণ্ডেয় আশ্রম। এখানে প্রতিষ্ঠিত আছেন পঞ্চমুখী মহাদেব। আচার্য শঙ্কর যখন নর্মদা দর্শনে এসেছিলেন, তখন তিনি এই স্থানে পঞ্চমুখী মহাদেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথিত আছে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় এই স্থানে প্রথম পঞ্চমুখী শিবের পূজা করেছিলেন।
নর্মদা মন্দির থেকে সাত কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত কপিলধারা। কপিলধারার কথা উল্লেখিত হয়েছে স্কন্দপুরাণে। যাত্রাপথ চির, দেবদারু, পাইন ,শাল ,সেগুন প্রভৃতি মনোলোভা বৃক্ষে পরিপূর্ণ। নর্মদা মন্দির থেকে উদগত নর্মদার জলধারা এই স্থানে প্রথম পড়েছে পাহাড়ি খাদে। এই জলধারা এখানে কয়েকশো ফুট নীচে চক্রাকারে আছড়ে পড়ছে। তাই সৃষ্টি হয়েছে জলপ্রপাত। যৌবন প্রাপ্ত নর্মদার প্রমত্ত গর্জনের শুরু এই
কপিলধারাতে। এখানে নর্মদা নদীর জল গভীর নয় ।
পুণ্যলোভিরা অনেকেই স্নান করে থাকেন এই ধারাতে। কপিলধারার পর থেকেই শুরু হয়েছে দুর্ভেদ্য, গভীর বনভূমি। আর এই বনভূমির মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়েছেন দেবী নর্মদা। পরিবেশ এখানে অদ্ভুত গম্ভীর এবং শান্ত। পৌরাণিক যুগে এখানেই তপস্যা করেছিলেন মহর্ষি কপিল। কথিত আছে দুর্বাসা মুনিও কোন এক সময়ে কঠোর তপস্যা করেছিলেন এই স্থানে।
উৎস স্থলে নর্মদা একেবারেই রুগ্না। পরে অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনা এসে মিশেছে নর্মদার জলে আর তাতেই যৌবন প্রাপ্ত হয়েছেন দেবী নর্মদা। নর্মদা নদী তট প্রাচীন ভারতের উপাসনা ক্ষেত্র। নর্মদা স্থলে তপস্যা করেছেন যে সমস্ত যোগী ঋষি, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহর্ষি দত্তাত্রেয়, অঙ্গীরস, অঙ্গিরা, ভৃগু, পতঞ্জলি , সনক, কর্দম, চ্যবন, মার্কণ্ডেয় ,কপিল , শংকর, তৈলঙ্গস্বামী, গম্ভীরনাথ প্রমুখ। আজও পুণ্যের আশায় অনেকেই পরিক্রম করেন পূণ্যতোয়া নর্মদা নদীর গতিপথ ।
তথ্যসূত্র :
১. শিব ঠাকুরের বাড়ি – সোমনাথ।
২. ভারতের মন্দিরে মন্দিরে – শিব শংকর ভারতী।
🚩 নামামি নর্মদে 🚩