© ডঃ রাধেশ্যাম ব্রহ্মচারী
বর্তমানে বাবা লোকনাথ সারা পশ্চিমবঙ্গে খুবই জনপ্রিয় এবং জাগ্রত হয়েছেন। আর এই জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে তাঁর আশ্বাস যে, কোনো হিন্দু রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই হোক না কেন, বিপদে পড়ে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করলে বাবা তাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু লোকনাথ বাবার ভক্তদের এটুকু বিবেচনা করার শক্তি নেই যে, দেশ ভাগের প্রাক্কালে যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা নিহত হয়েছিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পাইকারি দরে যে হিন্দু হত্যা হয়েছিল, অথবা ১৯৯২ সালে অযোধ্যার মন্দির পুনর্নির্মানের সময় বাংলাদেশে যে হিন্দু হত্যা ও হিন্দু নারী ধর্ষণ হয়েছিল, বাবা লোকনাথ তাদের রক্ষা করেননি কেন? দেশ ভাগের সময়, ১৯৪৮ সালে, লোকনাথ বাবার শেষ জীবনের বাসস্থান বারদি থেকে ২৫/৩০ মাইল দূরে , ভৈরব পুলের ওপর এক ট্রেন ভর্তি হিন্দুকে কেটে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। লোকনাথ বাবা সেই অসহায় হিন্দুদের রক্ষা করেননি কেন? এবং আজও বাংলাদেশে যেসব হিন্দুরা মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হচ্ছেন, তাদের রক্ষা করার জন্য লোকনাথ বাবার কোনো আগ্রহ নেই কেন? আসল কথা হলো, হিন্দুরা আজ পরিণত হয়েছে একটা ক্লিব জাতিতে। তাই তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার কথা ভাবছে না, ভাবছে অন্য কেউ তাদের রক্ষা করবে।
লোকনাথ বাবার এইসব ক্লিব ভক্তের দল একটা চলচ্চিত্র তৈরি করেছে এবং তাতে দেখা যাচ্ছে বাবা যোগবলে মক্কায় চলে গিয়েছেন। মক্কায় বাবা এক মৌলভীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেই মৌলভীকে তিনি বলছেন, আমি তোমার কাছ থেকে নেব কোরআন আর তুমি আমার কাছ থেকে নেবে পুরাণ। অর্থাৎ কোরআন আর পুরাণ একই জিনিস। এর পর সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর যে অংশটা দেখানো হচ্ছে তা হলো, দেশে ফিরে বাবা তাঁর শিষ্যদের বলছেন যে, বাবা তাঁর জীবনে তিনজন খাঁটি বিপ্র দেখেছেন, যাদের মধ্যে মক্কার ওই মৌলভীটি একজন। আরবের একজন মুসলমান মৌলভীকে একজন সাত্ত্বিক ও সৎকর্মশীল ব্রাহ্মণের সঙ্গে তুলনা করার মধ্য দিয়ে ওই ছবিতে ইসলাম ও তার মোল্লা মৌলভীদের সম্বন্ধে যে বিকৃত তথ্য প্রচার করা হয়েছে, তার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে হাজার হাজার হিন্দু মেয়ে মুসলমানকে বিয়ে করলেও তাদের কোনো দোষ দেওয়া চলে না।
সকলেরই জানা আছে যে , দেশ বিভাগের প্রাক্কালে মুসলমানদের তাড়া খেয়ে, বিগত ১৯৪৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পূর্ববঙ্গে পাবনার বসবাস তুলে দিয়ে ভারতের দেওঘরে এসে উঠেছিলেন। যে মুসলমানের তাড়া খেয়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন, ভারতে এসে সেই মুসলমানদের গুরু মহম্মদ সম্পর্কে লিখলেন,
বুদ্ধ ঈশার বিভেদ করিস, চৈতন্য রসূল কৃষ্ণে।
জীবদ্ধারে হন আবির্ভাব, একই ওঁরা তাও জানিসনে।।
অথবা,কৃষ্ণ রসুল যীশু আদি, নবরূপী ভগবান।
তুমি যে তাদের মূর্ত প্রতীক, প্রেরিত বর্তমান।।
এই বাণীগুলিতে রসুল বলতে যে ইসলামের প্রবর্তক মহম্মদকে বলা হয়েছে, তা হয়তো কাউকে বোঝাতে হবে না।কাজেই ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মহম্মদকে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সমান বলেছেন। সেই রকম গুজরাটের অহিংস অবতার তাঁর প্রার্থনা সভায় গীতা ও কোরআন পাঠ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে গীতাও যা, কোরআনও তাই। কাজেই এইসব কোথায় বিভ্রান্ত হয়ে হিন্দু সমাজের কোন মেয়ে যদি কোনো মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করে তবে তাকে কখনোই দোষ দেওয়া চলে না।
তা ছাড়া এসব কিছুর ওপরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত তত পথ। এই যত মত তত পথ-কে ভুল ব্যাখ্যা দিতে মহেন্দ্র গুপ্ত বা মাস্টারমশাই শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থে বলছেন, হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানরা একই পুকুরের জল খাচ্ছে, কিন্তু হিন্দুরা বলছে জল, মুসলমানরা বলছে পানি আর খ্রিস্টানরা বলছে ওয়াটার। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এর থেকে ভুল প্রচার আর কি হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, যত মত তত পথ বলতে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতে চেয়েছেন যে, হিন্দু ধর্মের সাকার ও নিরাকার অথবা যে সব শাখা-প্রশাখাগুলো রয়েছে, যেমন বৈষ্ণব, শক্ত, শৈব, গাণপত্য ইত্যাদি-এগুলো সব সমান। কিন্তু সেই যত মত তত পথ-এর বিকৃত ব্যাখ্যা আজ হিন্দু সমাজের ধ্বংসের একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো , শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-তে যা লেখা আছে, তা সব শ্রীরামকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী বলে ধরে নেওয়া উচিত নয়। শ্রী মহেন্দ্র গুপ্ত মহাশয় ছিলেন একজন স্কুল মাস্টার। তাঁর পক্ষে রোজ দক্ষিনেশ্বর যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি শুধু রবিবার ও ছুটির দিনগুলিতে দক্ষিনেশ্বর যেতেন। দক্ষিনেশ্বর যাবার যানবাহন বলতে ছিল নৌকো। তাই স্কুলের ছুটির পর দক্ষিনেশ্বর গিয়ে সেই দিনই দক্ষিনেশ্বর থেকে কলকাতা ফিরে আসা ছিল অসম্ভব কাজ। তাই রবিবার ও ছুটির দিনে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে মাস্টার মশাই অন্যান্য দিনগুলিতে ঠাকুর কি কি বলেছেন, তা অন্যান্য ভক্ত ও চাকর বাকরদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করতেন এবং তা লিখে নিতেন। পরে বাড়িতে ফিরে তিনি নিজের জ্ঞানবুদ্ধি দ্বারা শূন্যস্থান পূরণ করে গল্প খাড়া করতেন। এবং এভাবেই তিনি হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের এক পুকুর থেকে জল খাবার গল্প তৈরী করেছেন। তাই স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠের সাধুদের নিয়মাবলী গ্রন্থে বলেছেন যে, বছরের পর বছর ধরে খুব কাছ থেকে ঠাকুরকে দেখেছেন, একমাত্র তারাই ঠাকুরের বিষয়ে কিছু লেখার অধিকারী।
(ক্রমশঃ)