© তপন কুমার ঘোষ
শাস্ত্র অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ মানবদেহে ১২৫ বছর বেঁচেছিলেন। রাম এবং কৃষ্ণ, বিষ্ণুর এই দুই কথিত অবতার সত্যিই অবতার ছিলেন কিনা সে বিষয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু এই দুইজন যে যুগ ও কালের নিরিখে নরশ্রেষ্ঠ ছিলেন এ বিষয়ে খুব বেশি দ্বিমত নেই। কিন্তু যে কথাটা সাধারণ হিন্দুরা বুঝতে পারে না অথবা বুঝতে চায় না তা হল স্বয়ং ভগবানও যখন ( যদি ) মানবী মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁরা এই পৃথিবীতে নরলীলা করতেই আসেন, দেবলীলা দেখাতে নয়। তাই তাঁদের সারাজীবনের সমস্ত কাজ ও ঘটনা মানুষের মতই হওয়ার কথা। দৈবী শক্তির সাহায্য নিয়ে যুক্তি ব্যাখ্যার বাইরে অলৌকিক ঘটনা ঘটানাে তাঁদের কাজ নয়। কিন্তু সাধারণ হিন্দুর ধারণা ঠিক উল্টো। তারা ভাবে অবতার মানেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী , আর অলৌকিক কাজ করার জন্যই তাঁর পৃথিবীতে আসা। রামভক্তদের মধ্যে ৯৯.৯ শতাংশ হিন্দুই জানে না যে রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করল তার আগে লক্ষ্মণ কোন গণ্ডিরেখাই টেনে যায়নি। অর্থাৎ লক্ষ্মণরেখা বলে কোন কিছুর উল্লেখ মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। ওটা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণের অনুবাদে এবং তুলসীদাসের রামচরিতমানসে ঢুকেছে । কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে লক্ষ্মণ একটা রেখা টেনে গিয়েছিল এবং সীতা সেই রেখা অতিক্রম করে বলেই রাবণ তাঁকে অপহরণ করতে পেরেছিল। এটা সত্য নয়। রাবণ কুটিরে ঢুকে গায়ের জোরেই সীতাকে অপহরণ করেছিল — ঠিক এরকমটাই বাল্মীকি রামায়ণে লেখা আছে। এছাড়াও গােটা রামায়ণ পড়লে পড়ে রাবণ , ইন্দ্রজিৎ , মারীচ প্রভৃতির যত অলৌকিক কাণ্ড বা শক্তি দেখা যায় রামচন্দ্রের কাজকর্মের মধ্যে অত অলৌকিকতা দেখা যায় না । অর্থাৎ আমার বক্তব্য , রামচন্দ্র নরশ্রেষ্ঠ ছিলেন , দৈবশক্তি বা অলৌকিক শক্তির প্রকাশ তার বৈশিষ্ট্য নয় ।
ফিরে আসি শ্রীকৃষ্ণের কথায় । কৃষ্ণের জীবনকাহিনী মূলত চারটি গ্রন্থে পাওয়া যায় — শ্রীমদ্ভাগবতম , বিষ্ণুপুরাণ , হরিবংশ এবং মহাভারত । এর মধ্যে আমার মহাভারতটা খুব ভালাে করে পড়া আছে । বাকিগুলাে সম্বন্ধে কম জানা আছে । ভালােভাবে পড়লে এবং খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে , দুইবার বিশ্বরূপ প্রদর্শন ও শিশু পাল বধের সময় সুদর্শন চক্র আহ্বান করা — এইরকম অল্প কয়েকটি ঘটনা ছাড়া প্রায় আর কোথাও কৃষ্ণের অলৌকিক শক্তির বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না । আমি সবাইকে আহ্বান করবাে , গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে পড়ুন , দেখবেন কৃষ্ণের জীবনের প্রায় সমস্ত ঘটনাই মানুষের মতাে । কখনও যুদ্ধে পালাচ্ছেন , কখনও চালাকি করছেন, কখনও পাণ্ডবদের বকাঝকা করছেন, কখনও বুদ্ধি দিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, সবই মানুষের মতাে।
দ্বাপর যুগের শেষে আবির্ভূত এই শ্রীকৃষ্ণের সারা জীবনের কাজ , ঘটনা ও শিক্ষা অসংখ্য। কৃষ্ণকে নিয়ে আজ পাঁচ হাজার বছর পরেও বিশ্বের একশাে কোটিরও বেশি মানুষ মেতে আছে । কৃষ্ণভক্তি প্রচুর মানুষের মধ্যে আজও আছে। এইখানেই আমাদের মতাে হিন্দু কর্মীদের ক্ষোভ। কৃষ্ণভক্তরা কৃষ্ণকে ভক্তি করেন , পূজা করেন কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেন না । শুধু তাই নয় , একথা তাদেরকে বলতে গেলে তারা বলেন তাে স্বয়ং ভগবান । ভগবান যা করতে পারে সাধারণ মানুষের দ্বারা কি তা সম্ভব? তাই ভক্তি সহকারে কৃষ্ণের পূজা করেতারকৃপা চাওয়াই মানুষের পরম কর্তব্য। কৃষ্ণের কাছ থেকে কিছু শেখা কর্তব্য নয়।
আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই , কৃষ্ণ ভক্তদের এই চিন্তা ও মানসিকতা সম্পূর্ণ ভুল। কৃষ্ণ যদি অবতারও হন তবুও তিনি মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এসেছিলেন , পূজা নেওয়ার জন্য নয়।
মানুষের জন্য কৃষ্ণের দেওয়া শিক্ষা অনন্ত । তার সবটা নেওয়া তাে দূরের কথা , তার পরিমাপ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয় । ছােট্ট শিশুর মা ক্ষীর-ননী হাতের নাগালের বাইরে ঝুলিয়ে রাখলে কিভাবে ক্ষীর-ননী চুরি করে খেতে হয় , ছােট্ট শিশুদেরকে সে শিক্ষাও তিনি দিয়ে গিয়েছেন । আবার কিভাবে জরাসন্ধের দু’পা চিরে দিয়ে হত্যা করতে হয় তাও তিনি ভীমকে শিখিয়েছিলেন । কৃষ্ণের এইসব অনন্ত ও অসংখ্য শিক্ষার মধ্যে তিনটি শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ যা মানুষ নিতে পারেনি , সেগুলি আজকে আমার আলােচ্য বিষয়।
প্রথম শিক্ষাটি হল সমস্ত মানুষের জন্য । দ্বিতীয় শিক্ষাটি আদর্শ নিয়ে চলা যে কোন সংগঠনের কর্মীদের জন্য এবং তৃতীয় শিক্ষাটি প্রত্যেকটি সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্য ।
কৃষ্ণ সারাজীবনেই কখনও অন্যের কাজ করে দেননি এবং নিজের কাজও অন্যকে দিয়ে করাননি ।
একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণ নিমন্ত্রিত। শিশুপালও নিমন্ত্রিত । সেই অনুষ্ঠানে শিশুপাল কৃষ্ণকে আজেবাজে কথা বলে অপমান করল। এই পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে কৃষ্ণের কি করা উচিৎ ছিল ? অনুষ্ঠান বাড়ি পাণ্ডবদের। সেখানে একজন অতিথিকে আর একজন অতিথি অপমান করলে গৃহকর্তারই উচিৎ হস্তক্ষেপ করা এবং নিমন্ত্রিত অতিথির সম্মান রক্ষার জন্য যথাযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। সেই ক্ষমতা পাণ্ডবদের ছিল । কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষ্ণ গৃহকর্তার তােয়াক্কা না করে নিজেই অস্ত্র চালিয়ে শিশুপালকে বধ করলেন । অর্থাৎ তাঁর অপমানের প্রতিকার করার সুযােগ অন্য কাউকে দিলেন না , নিজের কাজ নিজে করলেন । আবার জরাসন্ধকে মারার সময় নিজে হাত লাগালেন না। শুধু ভীমকে বুদ্ধি দিলেন। কারণ কী? কারণ , জরাসন্ধ ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণের কোন ক্ষতি করেনি। কিন্তু সে বহু রাজাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে রেখেছিল। তাই সমস্ত রাজাদের প্রতিনিধি হিসাবে পাণ্ডুপুত্রকে ( রাজপুত্র ) দিয়ে জরাসন্ধের অন্যায়ের প্রতিকার করলেন ।
কৃষ্ণের ঘটনাবহুল জীবনে সবথেকে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ । এই যুদ্ধ রচনা করে তিনি সাধারণ মানুষকে ওই শিক্ষাটাই খুব বড় ভাবে দিতে চেয়েছেন । পাণ্ডবদের রাজ্য অন্যায় করে ছলচাতুরি করে কৌরবরা নিয়ে নিয়েছিল । তার আগেও জতুগৃহ প্রভৃতি অনেক ঘটনায় কৌরবরা পাণ্ডবভাইদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেছিল । এই বিশাল যুদ্ধে সেইসব কিছুর ফয়সালা হবে এবং পাণ্ডবদেরকে নিজেদের রাজ্য উদ্ধার করতে হবে । তাহলে কাজটা কার ? দরকারটা কার ? পাণ্ডবদের । কারা ধর্মের পথে আছে ও কারা অধর্ম করেছে ? কৌরবরা অধর্ম করেছে এবং শত কষ্টেও পাণ্ডবরা ধর্মের পথ ছাড়েনি । এই পটভূমিতে যখন এই বিশাল যুদ্ধ লাগল তখন কৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষে হাত লাগাবেন না , অস্ত্র ধরবেন না আগেই এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন । এবং যুদ্ধে সেটা করেও দেখালেন । তাহলে শিক্ষাটা কি ? তা হল , পাণ্ডবদের কাজ পাণ্ডবদেরকেই করতে হবে । কৃষ্ণ কিছুতেই প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবেন না — সে পাণ্ডবরা যতই তাঁর ঘনিষ্ট হােক আর যতই ধর্মপক্ষে থাকুক । এমনকি যখন তাঁর প্রিয় সখা অর্জুনের প্রিয়পুত্র বীর অভিমন্যুকে অন্যায়ভাবে যুদ্ধে হত্যা করা হল তখনও কৃষ্ণ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন না। তাহলে যে কৃষ্ণ তাঁর জীবৎকালে আত্মীয় বান্ধব সখা প্রিয় পাণ্ডবদের কাজে হাত লাগালেন না , সেই কৃষ্ণ পাঁচ হাজার বছর পরে শুধু নামগান করা ভক্তদের উদ্ধারে এগিয়ে আসবেন এটা আশা করা উচিৎ কি ? গােটা পূর্ববঙ্গে দেশবিভাগের সময় যখন মুসলমানরা হিন্দুদের কচুকাটা করছিল , সম্পত্তি লুঠ করছিল , নারীদের ধর্ষণ করছিল তখন সেখানকার কৃষ্ণভক্ত হরিনাম করা হিন্দুরা পাণ্ডবদের মতাে হাতে অস্ত্র তুলে না নিয়ে শুধু কোথা কৃষ্ণ , হা কৃষ্ণ বলে বুক চাপড়াচ্ছিল । এটা কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের দেওয়া শিক্ষার ঠিক বিপরীত আচরণ হল না । হ্যাঁ , তাই হল । পূর্ববঙ্গের বৈষ্ণব হিন্দুরা কৃষ্ণের শিক্ষা অমান্য করে অধর্ম করেছিল। পরিণাম যা হওয়ার তাই হল। লাঞ্ছিত , অপমানিত ও গৃহচ্যুত হল । যারা বেঁচে থাকল তারা রিফিউজি হল , বাকিরা মারা গেল ।
সর্বসাধারণ মানুষের জন্য এই ছিল কৃষ্ণের শিক্ষা । নিজের কাজ নিজে করতে হবে । নিজের প্রাণ , সম্মান ও সম্পত্তি রক্ষা নিজে করতে হবে । ভগবান এসে করে দেবে না । ভগবানকে আকুল হয়ে ডাকলেও করে দেবে না ।
দ্বিতীয় শিক্ষা, যে কোন আদর্শবাদী সংগঠনের কর্মীদের জন্য । সেই শিক্ষার নাম আমার মতে অপ্রেম বা প্রেমহীনতা । সাধারণ মানুষ কৃষ্ণকে প্রেমের দেবতা বলে মনে করে । আমি মনে করি কৃষ্ণ অপ্রেমের দেবতা বা অবতার । কৃষ্ণের বাল্যকাল নিয়ে কত লীলা , কত গল্প । হাসি-কান্না , খেলা , নাচ গান , দুষ্টুমি প্রেম-বৃন্দাবনের সে কত কাহিনী । সেখানে সকলের নয়নমণি বালক কৃষ্ণ । কতজন কত নামে ডাকে । ছােট্ট কৃষ্ণ সকলের আদর ভালােবাসা স্নেহ পায় । আর বন্ধুদের মধ্যে সে তাে মধ্যমণি । কত আনন্দে তার দিন কাটে । তার উপর সে তাে ছিল বৃন্দাবনে আশ্রিত বালক । ঐ বৃন্দাবনই তাে তাঁকে কংসের হাত থেকে রক্ষা করে আশ্রয় দিয়েছে । সেই বৃন্দাবন বা গােকুল কৃষ্ণকে আশ্রয় দিয়েছে , নিরাপত্তা দিয়েছে , স্নেহ ভালােবাসা সবকিছু দিয়েছে । সেই কৃষ্ণ যখন দশ বছর আটমাস বয়সে গােকুল ছেড়ে মথুরা গেলেন নিজের মামা কংসকে বধ করতে , তারপর সারা জীবনে একবারও তিনি আর গােকুলে ফিরে আসেননি । তিনি পরবর্তী জীবনে দ্বারকাধীশ হয়েছেন । কত তাঁর নামডাক হয়েছে । বৃন্দাবনবাসীরা সেইসব কথা শুনেছে জেনেছে । তাদের সেই আদরের গােপাল যদি একবার বৃন্দাবনে আসত তাহলে বৃন্দাবনবাসী কত খুশি হত ? মা যশােদা যিনি গােপালকে বুকের দুধ খাইয়েছেন তাঁর মনপ্রাণ কত ভরে যেত ! এটুকু করা কি কৃষ্ণের কর্তব্য ছিল না । বৃন্দাবনের ঋণ মেটাতে এটুকু করা কি তাঁর উচিৎ ছিল না ? সাধারণ মানুষ হলে তা ছিল । কিন্তু কৃষ্ণ তাে সাধারণ মানুষ নন । তিনি তাে অসাধারণ মানুষ । তাই তিনি অপ্রেমী । প্রেমহীন স্নেহহীন মমতাহীন । ( নির্মমাে নিররষ্কার সমঃ দুঃখ সুখক্ষমী ) তাঁর জীবনে প্রেম দয়া মায়া স্নেহ মমতা করুণা কোন কিছু ছিল না । শুধু ছিল একটাই জিনিস , তা হল কর্তব্য । সেকর্তব্য কী ? অধর্মের নাশ করে ধর্ম স্থাপন করা । অনুরাগ বা বিরাগের জন্য কেউ তাঁর আপন নয় , কেউ তাঁর পর নয় । তাই স্নেহ ভালােবাসা কৃতজ্ঞতায় তিনি কারাে কোন উপকার করবেন না , কাউকে কোন সাহায্য করবেন না , অধর্মের নাশ ও ধর্মের স্থাপনের জন্য যা যা করণীয় শুধু তাই করবেন । তাঁর জীবনের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত ছিল । যে কোন আদর্শ নিয়ে চলা প্রত্যেক সংগঠনের প্রত্যেকটি কর্মীর এই শিক্ষা নেওয়া উচিৎ । আদর্শ মানে লক্ষ্য । সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে যখন যা করা দরকার তখন তাই করবাে , কারাে প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের জন্য নয় , কারাে প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে নয় । শুধু আদর্শের জন্য কাজ করবাে , শুধু লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য কাজ করবাে , তার জন্য মায়া মমতা স্নেহ ভালােবাসা ত্যাগ করতে হবে । কর্তব্য পালনের জন্য মমতাহীন অর্থাৎ নির্মম হতে হবে । এই ছিল কৃষ্ণের দ্বিতীয় শিক্ষা – সংগঠনের কর্মীদের জন্য ।
কৃষ্ণের তৃতীয় শিক্ষা । এই শিক্ষা যে কোন সংগঠনের ( কোম্পানি বা অফিস বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয় ) সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্য ।
কৃষ্ণ মৃত্যুর আগে অর্থাৎ নিজের জীবন শেষ হওয়ার আগে নিজ বংশকে ধ্বংস করে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । যে কোন সফল ব্যক্তি জীবনে অনেক ধনসম্পদ ও সুনাম অর্জন করে । যে কোন সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই জিনিস হয় । সংগঠনের সুনামকে আধুনিক পরিভাষায় ‘ গুডউইল ’ বা ‘ ব্র্যান্ড ভ্যালু ’ বলা হয় । এর অনেক দাম । এই ব্র্যান্ডকে ভাঙিয়ে অনেক কিছু করা যায় । টাকা রােজগার করা যায় , নেতা হওয়া যায় , এম.এল.এ. , এম.পি. হওয়া যায় , মন্ত্রী হওয়া যায় ইত্যাদি । কিন্তু যারা সংগঠনের ব্র্যান্ড বা গুডউইলকে ভাঙিয়ে এগুলাে করে তারা যে সেই সংগঠনের মূল আদর্শ অনুসার সেই আদর্শের পূর্তির জন্য কাজ করবে তার কোন গ্যারান্টি নেই । বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করে না । ঐ সংগঠনের নাম ও পদকে অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা ধান্দাবাজি করে । তার ফলে সাধারণ সমাজ প্রথমে ধোঁকা খায় এবং পরে ক্ষতিগ্রস্থ হয় । এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম । সমস্ত সংগঠনের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায় , সংগঠন বেশ কিছু ধান্দাবাজ ব্যক্তির কায়েমী স্বার্থপূরণের মাধ্যম বা উপকরণে পরিণত হয় । সংগঠনের প্রকৃত আদর্শবাদী নেতা ও কর্মীরা এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারে । সেই অবস্থায় সেই সংগঠন সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও অভিশাপ । এক সময়ে ভালাে উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া সংগঠনের দ্বারা তখন সমাজের ক্ষতিই হতে থাকে । সেই সংগঠন যদি তখন বন্ধ হয়ে যায় , ভেঙে যায় বা ভেঙে দেওয়া হয় তাতেই সমাজের কল্যাণ । কারণ সংগঠন তখন আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে ।
গান্ধীজী একথা খুব ভালােভাবেই বুঝেছিলেন বলেই দেশের স্বাধীনতার পরেই তিনি কংগ্রেসকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন । আর.এস.এস. প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলেই তিনি ঘােষণা করেছিলেন যে , তাঁর সংগঠনের যেন কোন জুবিলি ( জয়ন্তী ) পালন না করতে হয় । প্রথম জয়ন্তীকে বলে রৌপ্য জয়ন্তী , যা ২৫ বছরে পালিত হয় । ডাক্তারজীর চিন্তা অনুসারে সংঘের কাজ ২৫ বছরের বেশি চলবে না । সেজন্য তিনি যেমন জুবিলি পালন না করার কথা বলেছিলেন ঠিক তেমনি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন , “ ইয়াচি দেহী ইয়াচি ডােরা ” ( মারাঠি ভাষায় ) যার অর্থ হল “ এই দেহে এই চোখে ” । সুতরাং ডাক্তারজী নিজের চোখে সংঘের লক্ষ্যপ্রাপ্তি দেখে যেতে চেয়েছিলেন যার জন্য ২৫ বছরের বেশি সময় লাগবে না । আর সেইজন্যই তিনি সংঘের কোন সংবিধান তৈরি করে যাননি । ডাক্তারজীর জীবনকালেই সংঘের কার্যপদ্ধতির বেশ কিছু পরিবর্তন তিনি করেছিলেন । তার মধ্যে সবথেকে বড় পরিবর্তন ছিল ১৯৪০ সালে একটি দীর্ঘ কেন্দ্রীয় বৈঠকে সংঘের মারাঠি ও হিন্দি ভাষায় প্রার্থনা পরিবর্তন করে সংস্কৃত ভাষায় সম্পূর্ণ অন্য প্রার্থনা তৈরি ও গ্রহণ করা । কিন্তু তখনও তিনি সংঘের জন্য কোন সংবিধানের প্রয়ােজনীয়তার অনুভব করেননি । কেন কেউ ভেবে দেখেছেন কি ? আমার মতে সংঘের কাজ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় , দ্রুত লক্ষ্যপ্রাপ্তি করে যেন এই সংগঠনের বিসর্জন হয়ে যায় , সেইজন্যই ডাক্তারজী সংগঠনের কোন সংবিধান তৈরির দরকার মনে করেননি ।
বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মগুরুকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলাের দিকে দেখুন । অনুকূলচন্দ্র , স্বরূপানন্দ , মতুয়া , রামঠাকুর — এগুলির সবগুলিই এক একজন গুরুর অনুগামী গােষ্ঠী , তা থেকে সম্প্রদায় এবং সেই সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সংগঠন । গুরুর হয়তাে একটা মহান উদ্দেশ্য বা আদর্শ ছিল , গুরুর ছিল আধ্যাত্মিক সাধনা বা উপলব্ধি । কিন্তু গুরু পরবর্তী তাঁর সংগঠনে সেসব আর কিছু থাকে না । থাকে শুধু কায়েমী স্বার্থ । আর সেই কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গুরুর নাম ভাঙানাে এবং প্রচার ও মার্কেটিং পদ্ধতিতে শুধু মেম্বার বাড়ানাে , যাতে ইনকাম আরও বেশি হয় আর তা দিয়ে আরও মৌজমস্তি বেশি করা যায় ।
এই সংগঠন ব্যাপারটা আধুনিক যুগের । মানব ইতিহাসে প্রথম সংগঠন সম্ভবত বৌদ্ধ সংঘ । তার আগে প্রাচীনকালে কোন সংগঠন ছিল না । ছিল বংশ ( Dynasty ) ও আশ্রম । আশ্রমগুলাে কোন শিষ্যগােষ্ঠী তৈরি করত না । আশ্রমের গুরুরা শিক্ষা দিতেন , উপদেশ দিতেন , দীক্ষা দিতেন কিন্তু দল পাকাতেন না । তাই আশ্রমের ও গুরুর বিরাট গুডউইল বা ব্র্যান্ড ভ্যালু থাকলেও সেটাকে ভাঙানাের সুযােগ ধান্দাবাজরা পেত না । অনুরূপভাবে বিভিন্ন বংশের ব্যান্ড ভ্যালু তৈরি হত । আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ব্র্যান্ড ভ্যালু ছিল রঘুবংশের । সম্ভবত সেই কারণেই অযােধ্যার রাজপুত্র রাম সুদূর দক্ষিণ ভারতে গিয়েও অতখানি স্বীকৃতি ও গুরুত্ব পেয়েছিলেন । কিন্তু যে সব বংশের বিরাট সুনাম বা ব্র্যান্ড ভ্যালু ছিল সেসব বংশের উত্তরাধিকারীর যেমন তার সুবিধা ভােগ করতেন তেমনি সেই সুনামকে রক্ষা করার জন্যও তাদেরকে অনেক পরিশ্রম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হত । আর কোন উত্তরাধিকারী যে সেই সুনামের অপব্যবহার করত না , তা তাে নয় । অনেকেই করত । ফলে সেই বংশের সুনামও শেষ হয়ে যেত । কিন্তু তার মধ্যেই সমাজের অনেক ক্ষতি হত আর প্রজা বা সাধারণ মানুষের অনেক কষ্ট হত । সেইজন্যই পরশুরামকে একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় বা ক্ষত্রিয়হীন করতে হয়েছিল ।
শিক্ষা হল এই যে শক্তিশালী যদি নীতিহীন ও আদর্শহীন হয় তাহলে সে দুর্বলের উপর অত্যাচার করবে । সেই শক্তিশালী যদি কোন গুরুর বা কোন বংশের উত্তরাধিকারসূত্রে ব্র্যান্ড ভ্যালুর মালিক হয় তাহলে সে আরও বিনা বাধায় অত্যাচার ও শােষণ করতে যেতে পারবে ।
কৃষ্ণ সর্বজ্ঞ ছিলেন কিনা জানি না । কিন্তু আমাদের থেকে হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান , অভিজ্ঞ , অন্তদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন । তাই তিনি পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের চিত্র । তাঁর সারাজীবনের কাজের ফলে তৈরি গুডউইল বা ব্র্যান্ড ভ্যালু তাঁর বংশধররা কীভাবে অপব্যবহার করবে তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন । তাঁর যদুবংশ ( পাঠক ভুল করবেন না , যদু বংশ মানে যাদব বংশ নয় । যাদবরা কৃষ্ণকে আশ্রয় দিয়েছিল , কিন্তু কৃষ্ণ ছিলেন ক্ষত্রিয় যদুবংশের সন্তান ) পরবর্তী দিনে কায়েমী স্বার্থের ঘাঁটি হয়ে যাবে — তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন । কৃষ্ণের জীবনের কোন আদর্শই তারা পালন করবে না , বরং সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন । তাই সেই বংশ ধ্বংস করে যাওয়া তাঁর অন্যতম কর্তব্য এবং “ ধর্মসংস্থাপনার্থায় ” -এর জন্য একটি প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ বলে তিনি মনে করেছিলেন । সেই কাজ সম্পন্ন করে গেলেন।তাইকৃষ্ণের জীবনে শেষ কাজ , নিজের যদুবংশ ধ্বংস করা । বর্তমানে সমস্ত সংগঠনের নেতৃত্বের জন্য দেওয়া এটাই হচ্ছে । তাঁর অমােঘ শিক্ষা । মাও সে-তুঙ্ গীতা পড়েছিলেন কিনা জানি না , কৃষ্ণের জীবনকাহিনী জানতেন কিনা জানি না , কিন্তু জীবনের প্রায় শেষবেলায় তার সেই বিখ্যাত উক্তি , “ সদর দপ্তরে কামান দাগাে ” শুনে আমার মনে হয়েছিল তিনি যেন কৃষ্ণেরই কাজের প্রতিধ্বনি করছেন । যাই হােক , প্রত্যেকটি সংগঠনের নেতৃত্বকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে যে সংগঠন তার আদর্শকে ধরে রাখতে পেরেছে , না হারিয়ে ফেলেছে । যদি আদর্শ হারিয়ে যায় তাহলে সেই সংগঠন কায়েমী স্বার্থের ডেরা হয়ে যায় । তখন সেই সংগঠনের অবলুপ্তি দেশ ধর্ম ও সমাজের জন্য কল্যাণকর । কৃষ্ণ শুধু সেই উপদেশ না দিয়ে নিজের হাতে করে দেখিয়ে গিয়েছেন । নিজে যদুবংশ ধ্বংস করে ।
গত পাঁচ হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব শ্রীকৃষ্ণের জীবনের এই তিনটি শিক্ষা সকলে একটু ভেবে দেখুন , এই অনুরােধ রইল ।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় স্বদেশ সংহতি সংবাদের ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সংখ্যায়)