© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
বঙ্গ সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হল দুর্গাপূজা। শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, শিউলি ফুলের মনকাড়া গন্ধ, কাশফুল, আর সকালের হিমেল হাওয়া প্রকৃতিতে দৃশ্যমান বা অনুভূত হলেই শুরু হয় দুর্গা পূজার তোড়জোড়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কবে থেকে শুরু হল এই মাতৃ আরাধনা।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে হরপ্পা সভ্যতা ও চন্দ্রকেতুগড় সভ্যতায় দশায়ুধা মাতৃকা পূজিত হতেন। হরপ্পাতে সিংহবাহিনী মাতৃকা না পাওয়া গেলেও ব্যাঘ্র সহ মাতৃকা মূর্তি খোদিত একটি ছাপ পাওয়া গেছে। সুমের, ব্যাবিলন এমনকি প্রাচীনকালের ইউরোপীয় পেগানদের মধ্যেও মাতৃকা শক্তির আরাধনা প্রচলিত ছিল। এই সব স্থানে কিন্তু মাতৃকা মূর্তি ছিল সিংহবাহিনী । উত্তর-পশ্চিম ভারতেও সুপ্রাচীন কাল থেকে সিংহবাহিনী মাতৃকা মূর্তির উপাসনা চলছে। বাংলাতে পাল যুগে ( অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী) প্রথম সিংহবাহিনী চণ্ডীর মূর্তি পাওয়া গেছে। তবে প্রাচীন কালের যেসব মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি কিন্তু আজকের দূর্গা মূর্তির মত ( লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ বিগ্রহ সহ) ছিল না। তবে এইসব মাতৃ মূর্তি প্রমাণ করে বাঙালির মাতৃকা পূজনের ইতিহাস। আর দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গার পূজা যে মাতৃকা পূজনীয় ঐতিহ্যকেই বহন করে চলেছে সেটা বলা বাহুল্যমাত্র।
এখন আমরা দেখে নিতে পারি দুর্গা শব্দটির উৎপত্তি। দুর্গার শব্দের ‘ দ ‘ বোঝায় দৈত্যনাশকারী; ‘ উ ‘ বিঘ্ন নাশকারী; ‘রেফ ‘ রোগনাশকারী; ‘গ ‘ পাপনাশকারী; আর ‘ আ ‘ শত্রু নাশকারী। সেই অর্থে দেবী দুর্গা হলেন দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ এবং শত্রু বিনাশকারী। আবার শব্দকল্পদ্রুম অনুযায়ী দুর্গ বা দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন যিনি তিনি হলেন দুর্গা। শ্রী শ্রী চন্ডী অনুযায়ী দুর্গা হলেন সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। ঋকবেদ ও অথর্ববেদের মন্ত্রে আমরা দুর্গা নাম এবং তার প্রতি শব্দের উল্লেখ পাই।
অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্র গুলিতেও আমরা দুর্গাপূজার উল্লেখ পাই, যেমন আনুমানিক 400 থেকে 600 খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লিখিত দেবীমাহাত্ম্য নামে একটি গ্রন্থে আমরা রূপ বদল করতে সক্ষম, অন্ধকার শক্তির ধারক মহিষাসুর নামে এক অসুরের উল্লেখ পাই । দুর্গার দ্বারা এই মহিষাসুর বধের কথা এখানে বর্ণিত হয়েছে। মহাভারতে আবার যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের দুর্গা বন্দনার উল্লেখ রয়েছে। হরিবংশতে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
কোন কোন পুরাণে দুর্গাপূজাকে বসন্তের উৎসব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত আছে বসন্তকালে চৈত্র নবরাত্রিতে (শুক্লপক্ষ ) কালকেতু নামে এক ব্যাধ দুর্গাপূজার সূচনা করেন। তবে দেবীভাগবত পুরাণ এবং অন্যান্য শাক্ত পুরাণ দুর্গাপূজাকে শরৎকালীন উৎসব বলে বর্ণিত করেছে। বর্তমান ভারতে চৈত্র নবরাত্রি পালনের সঙ্গে সঙ্গে শরতকালের শুক্লপক্ষতেও দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাঙালি সমাজে এই দুর্গাপূজা অকালবোধন নামে পরিচিত। কথিত আছে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম রাবণ বধের নিমিত্তে দুর্গার আরাধনা করে থাকেন। বাল্মীকি রামায়ণের কিন্তু এইরূপ কোনো ঘটনার কথা পাওয়া যায় না। সেখানে রাবণ বধের পূর্বে শ্রীরাম যে শক্তির আরাধনা করেন, সেই শক্তি হল অন্যতম বৈদিক দেবতা সূর্য। পঞ্চদশ শতকের অন্যতম বাঙালি রামায়ণকার শ্রী কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে শ্রীরামের হাত দিয়ে মা দুর্গার পূজা করান। সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দুর্গাপূজাকে বাংলাতে জনপ্রিয় করা।
যাইহোক শরৎকালের দুর্গাপূজা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার উপযুক্ত প্রমাণ কিছু নেই। যদিও বাঙালি প্রাচীনকাল থেকেই মাতৃকা আরাধনা করত, তবে যতদূর প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় উৎসব আকারে বাঙালির দুর্গাপূজা শুরু হয় মধ্যযুগে। ইসলামিক শাসনে বাঙালি হিন্দু যখন সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে, তখন ধুমধাম করে জনসমক্ষে শক্তি পূজা আরম্ভ করে বাঙালি হিন্দু। ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যেই এই পূজা সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়। সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে হুগলির গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে বারো জন বন্ধু বা ইয়ার মিলে সার্বজনীন পূজা আয়োজন করে। এই পূজা বারোয়ারি পূজা নামে খ্যাত হয়। সেই থেকেই আজকের বারোয়ারি পূজার উদ্ভব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাঙালি জমিদার এবং বাবুরা নিজেদের বাড়িতে দুর্গাপূজা আয়োজন করতেন এবং সেই দুর্গাপূজার আভিজাত্য বাড়ানোর জন্য ব্রিটিশ সাহেবদের ডেকে আনতেন। ঔপনিবেশিক যুগে এ ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুকে খুশি করার এক প্রচেষ্টা। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলায় শক্তিপূজাকে জনপ্রিয় করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠের দুর্গা পূজা আরম্ভ করেন। এই দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কুমারী পূজা, যা আজও রামকৃষ্ণ মিশন করে থাকে। এই কুমারী পূজা মাতৃশক্তি আরাধনার এক বিশেষ দিক বলে পরিগণিত হয়। স্বামীজীর মনে হয়েছিল মাতৃশক্তিকে পূজা না করলে জাতির উত্থান সম্ভব নয়।
স্বাধীনোত্তর যুগে পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা এক আলাদা মাত্রা লাভ করে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা হলেও তার জৌলুস কমতে থাকে বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হবার পরে। এই একবিংশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজার প্রাক্কালে বা পূজার সময়ে বাংলাদেশে দুর্গা মূর্তি ভাঙ্গা বা অবমাননা করা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাতে পরিণত হয়েছে। তবে সুদূর আমেরিকাতে কোন কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশের দ্বারা অত্যাচারিত হলে, যেরূপ প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গে হয়, দুর্গা মূর্তি ভাঙার কোন রকম প্রতিবাদ কিন্তু সে রূপ পরিলক্ষিত হয় না।
একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গে আবার দেখা যাচ্ছে দুর্গাপূজার এক নতুন প্রকৃতি – থিম পূজা। কোন একটি সামাজিক বা পরিবেশগত কোন বিষয়কে তুলে ধরার জন্য দুর্গা পূজাকে ব্যবহার করা হল থিম পূজার উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এই বছর একটি দুর্গা মণ্ডপে দুর্গা মায়ের বিগ্রহকে পরিযায়ী শ্রমিক এর রূপ দেওয়া হল: আরেকটি জায়গায় দুর্গা মূর্তি হয়ে গেল করোনার চিকিৎসাকারী লেডি ডক্টর। বুদ্ধিজীবী মহল ‘সাধু সাধু’ রব করতে লাগলেন। সত্যিই তো পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়ে এবং করোনার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করবার জন্য কি সুন্দর প্ল্যাটফর্ম এই দুর্গাপূজা! আচ্ছা তাহলে আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছি, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটাও তো পরিযায়ী শ্রমিক এর আদলে কিংবা করোনা যোদ্ধা ডাক্তারের বা সাফাই কর্মীর আদলে আমরা তৈরি করতে পারতাম!! আজকাল ফটোশপের কায়দায় এটা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু তাহলে ফলাফল কি হবে? বাংলার জনগণ কি সাধু সাধু রব করবেন, না প্রতিবাদের ঝড় তুলবেন। আমার মনে হয় এইরূপ থিমের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হলে প্রতিবাদেরই ঝড় উঠবে, কারণ আমরা যাকে ভালোবাসি তার বিকৃত রূপ আমরা দেখতে চাই না। এর মানে এই নয় যে পরিযায়ী শ্রমিক, করোনা যোদ্ধা ডাক্তার কিংবা সাফাই কর্মী আমাদের কাছে সম্মানের নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা ওই রুপে দেখতে অভ্যস্ত নই এবং সেটা ঐতিহ্যবিরোধী। দুর্গা মাতার ক্ষেত্রেও কি ঠিক একই কথা প্রযোজ্য নয়? আগামী দিনে আমরা যদি এই বিকৃত সংস্কৃতির প্রতিবাদ না করি, তাহলে মাতৃ শক্তির আরাধনা নিছক একটি প্রদর্শনীতে পরিণত হবে। অনেকে এখানে হয়তো বলবেন এটি শিল্পকলা। হ্যাঁ সনাতন ধর্মে উৎসবের সঙ্গে শিল্পকলার যোগাযোগ রয়েছে। আজ থেকে কুড়ি – তিরিশ বছর আগে বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার সঙ্গে বিজ্ঞান প্রদর্শনী আয়োজন করা হত। দুর্গাপূজার সময়ও করা হোক চিত্র, ভাস্কর্য কিংবা লেখালেখির প্রদর্শনী। পুরস্কার তার উৎকর্ষতার উপরে দেওয়া হোক । তার জন্য দুর্গা মাতার বিগ্রহকে বিকৃত করার কি প্রয়োজন আছে? ভাবুন বন্ধুরা, ভাবা অভ্যাস করুন।