© মিতালী মুখার্জী
রঙধনু কী, বল দেখি মা?
রঙধনু টা কি?
আমি খুঁজি বইয়ের পাতায়
রামধনুর ছবি।
শৈশবের সেই শব্দগুলো
জড়িয়ে বুকে আছি
বল দেখি সব বদলে গেলে
কেমন করে বাঁচি !!!
স্বরচিত একটি কবিতার সুত্র ধরে মাকে করা এক ছোট্ট মেয়ের প্রশ্ন।
দিন দিন আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে বই এর পাতায় আমাদের পরিচিত শব্দ গুলো কেমন বদলে যাচ্ছে। রামধনু হয়ে যাচ্ছে রঙধনু। কেন? না এতে রাম আছে। রাম হিন্দুদের দেবতা। অতএব তার নাম উচ্চারণ করাও গুনাহ। পিছিয়ে যাই আর ও প্রায় ৭০ বছর পিছনে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোতে ছিল শ্রী বা পদ্মফুল। সেই সিম্বল বদলাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তখনকার মুসলিম লীগের কর্মকর্তারা। কিন্তু পাহাড়ের মত সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন পশ্চিমবঙ্গের পিতৃসম ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। ঠিক যেমন করে তিনি রক্ষা করেছিলেন বাঙ্গালী হিন্দুদের জন্য একমুঠো বঙ্গভূমি ।
সেই শুরু। এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের মুখে আজ আমাদের পশ্চিম বঙ্গের মাটি, আমাদের ভাষা, আমাদের ইতিহাস।
কিছুদিন আগেই রব উঠেছিল বঙ্গাব্দ আকবরের তৈরি। হা হতস্মী। দিল্লীর থেকে সাত রাজ্য পেরিয়ে আকবর এসেছিলেন বাঙ্গলায় বঙ্গাব্দ বানাতে ! যাই হোক , হিন্দু সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক যে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা তা আমরা প্রমান করতে পেরেছি।।
কিন্তু এই আগ্রাসন শুধু আমাদের সনাতনি ঐতিহ্য বা পরম্পরার তাই নয় , “বসুধেব কুটুম্বকম” বা “সর্বভূতে দেবোপম” -এর ধুয়ো ধরে আমরা বহিরাগতদের যতই বরণ করে নিয়েছি ততই তাঁরা আমাদের দুর্বল ভেবে একটু একটু করে কামড় বসিয়েছে আমাদের ধর্মে, আমাদের ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে। এ এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বাঙ্গলা ভাষার আরবিকরণ শুরু হয়েছিল সেই পাকিস্তানের মুক্তি যুদ্ধের সময় থেকে। পাকিস্তানের দাবী বা পাকিস্তানের রূপায়নের মধ্যেই সুপ্ত ছিল সেই ভাষা দখলের বীজ। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সুফী সমাজের হাত ধরে ধর্মান্তর এবং ভাষা দূষণের গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তা দিনে দিনে মুখ বিবর ব্যাদান করে গিলে খেতে শুরু করেছে আমাদেরই মাতৃভাষা বাঙ্গলা ভাষাকে। বিদ্যাসাগর যে ভাষার জন্য সারা জীবন দিয়ে গেলেন; বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের যে ভাষা বাঙ্গালীর মাথার ভূষণ, সেই রবীন্দ্র যুগেই দূষণে কলুষিত হল বাঙ্গলা ভাষা নজরুলের হাত ধরে। অজস্র উর্দু শব্দ স্রোতের মত ঢুকে পড়ল বাঙালীর অন্দর মহলে। আগে উর্দু ভাষার প্রয়োগ কিছু ধর্মগ্রন্থ বা বিশেষ জাতির কথিত ভাষার মধ্যেই সিমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু নজরুলের জনপ্রিয়তার সুযোগে তা স্হান করে নিল বাঙালীর হৃদয়ে। তাঁর বিখ্যাত জনপ্রিয় কবিতা গুলির মধ্যে অজস্র উর্দু ভাষার ছড়াছড়ি। তার গানের শব্দ উর্দু দূষণে ভরপুর। খুন, পেয়ালা, দোজখ, হরদম, খোদার আসন, কুর্নিশ, জাহান্নম, হিম্মত এমনই অজস্র শব্দ জায়গা করে নিল বাঙালীর অভিধানে।
আমাদের ভাষা ছিল আদিভাষা সংস্কৃতের ক্রোরে পালিত গৌরবময় তৎসম বা তদ্ভব এর ধারায় লালিত। তা ছিল দুটো ই কার, দুটো উ কার, অব্যয়, যুক্তাক্ষর দিয়ে সমৃদ্ধ। এখন অতি সন্তপর্ণে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাঙ্গলা ভাষার মূল স্রোতকে। প্রতিবছরই বাঙ্গলাদেশের অভিধানে অবলিলায় ঢুকে পড়ছে বিশ ত্রিশটা উর্দু শব্দ। আর যেহেতু এক ভাষা এক বর্ণ, তাই অতি অনায়াসে পশ্চিমবঙ্গ বাঙ্গলা অ্যাকাডেমি নিজের অভিধান রিভিউ করার সময় সেটাই বহাল রাখছে। রামধনু হয়ে যাচ্ছে রঙধনু , আকাশ হলো আশমান, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম রোমিং শব্দের থেকে আগত ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রমবর্দ্ধমান মাদ্রাসা গুলির প্রভাব পড়ছে উত্তর প্রজন্মের উপর তীব্রভাবে। পাশের বাড়ির আমির বা মজিদা ভোর কে বলছে ফজর , জলখাবারকে নাস্তা, জলকে পানি , স্নানকে গোসল্, খাওয়া কে খানা, বন্ধুকে দোস্ত, নিমন্ত্রণকে দাওয়াত। এইভাবে আজান, নামাজ সব আচার(অনাচার ) শিশুমনে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসেই। যে পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য বিদ্যাসাগর লিখলেন “আখ্যান মঞ্জরী ” বদলে যাচ্ছে সেই সম্পর্ক গুলোও । আদর্শ লিপি থেকেই তারা পড়ছে আম্মা, আব্বু, আপি, ফুফা, ফুফি ইত্যাদি। অঙ্কের বই -এ রাজীব বা রোহন-এর থেকে সলমন দৌড়াচ্ছে সবথেকে বেশি। সব জায়গায় হিরোইজমের ইমেজ পড়ছে ওদের ভাগে।
সিনেমা জগতেও এর প্রভাব প্রাদুর্ভাবের মতই ছড়িয়ে পড়ছে। খান সাম্রাজ্যের ভীড়ে মাথা তুলতে পারছেনা হিন্দু নায়কেরা। কিছুদশক আগে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রাজ করতো রাজেশ খান্না , জীতেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন,ধর্মেন্দ্র, মিঠুন চক্রবর্তী, তার ও আগে বিশ্বজিত ,বলরাম সাহানি , দেব আনন্দ , সুনিল দত্ত , প্রভৃতিরা। দিলীপ কুমার ছিলেন কিন্তু হিন্দু নামের আড়ালে। আর আজ !! সেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কয়েক দশক ধরে আমির, সলমন, সহবাজ, ইরফানদের দখলে। সবটাই কি কাকতালীয় ? না কোন আন্ডারগ্রাউন্ড ডন এর হাতে আছে এর অদৃশ্য সুতো??
মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে বাঙ্গলায় আসি। যাদবপুরিয়া বা কান্হাইয়াদের ও পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে ফিল্ম নির্মাতা অনুরাগ বাসুর কাবুলিওয়ালা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোট গল্প “কাবুলিওয়ালা” র মিনি কে দিয়ে সাড়ম্বরে তিনি পড়ালেন নামাজ। শুধু তাই না, মিনি তার বাবাকেও আহ্বান করছে নামাজ পড়ার জন্য যাতে “আল্লা” খুশি হবে এবং তাহলে তার “দোস্ত ” ফিরে আসবে !!! কেন !! আমাদের হিন্দুদের তেত্রিশকোটি দেবি দেবতা কম পড়ে গেছিল ?ইদানিং এক ফ্যাশন উঠেছে ইফতারে টুপি পরে বা মাথায় ঘোমটা দিয়ে নামাজ পড়া বা ইফতাবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার। রাস্তা জুড়ে আবার তা শোভা পাচ্ছে বড় বড় হোর্ডিং -এ। ধিক্।এইভাবেই আমাদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অধঃপতনের অতল গহ্বরে ঠেলে ফেলার , আমাদের সমৃদ্ধ ভাষাকে অপঘাতে মারার এক দূর্দমনিয় চেষ্টা চারিদিকে ঘনিয়ে উঠেছে । আর কিছু কূ “জাত”, কিছু স্হবির “কূ মন ” এবং রোদ্দুর রায় এর মত হঠাৎ উঠে আসা সেলিব্রেটিদের হাত ধরে বহাল তবিয়তে ঘর করে নিচ্ছে ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে এবং বাঙ্গলার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া সাধারণ মানুষ ও আড়াল আবডালে গা ঢাকা দেওয়া কিছু অসাধারণ মানুষ সেই বহতি গঙ্গায় হাত ধুয়ে “ফেমাস” হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি ।।
২০১৮ -এর উত্তর দিনাজপুরের দাঁড়িভিটা উচ্চ বিদ্যলয়ের ঘটনাও সেই গভীর ষড়যন্ত্রেরই স্বরূপমাত্র যেখানে দরকার না থাকা সত্বেও জোর করে ঢোকান হচ্ছিল দুজন উর্দু শিক্ষককে এবং প্রতিবাদের ফল স্বরূপ প্রাণ দিতে হল তরুন ভাষাবীর রাজেস সরকার ও তাপস বর্মনকে । ভাগ্যক্রমে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গেল বিপ্লব সরকার ও বাচ্চু সিকদার। সম্পূর্ণ ঘটনাটাই খুব সুন্দর দাবার ঘুঁটির মত সাজান ছিল উর্দু আগ্রাসনের হিসাব মত।
বাঙ্গলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বাম আমলে ইংরাজী শিক্ষার বিরোধিতা করার জন্য বিভিন্ন প্রান্তের দোকানের ইংরাজীতে লেখা সাইন্ বোর্ড ও টান মেরে ফেলে দিতে বাধ্য করেছিল। স্টেশনগুলোর ইংরাজী নাম মুছে দেওয়া হয়েছিল। আজ যখন বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তর থেকে রামায়ণ মহাভারতের পাঠ তুলে দেওয়া বাধ্যতামূলক হচ্ছে আর সেই জায়গা নিচ্ছে রাম-এর অর্থ রোমিং বা উর্দুর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেই বুদ্ধিজীবী সুধি সমাজ শঙ্খ সুবোধ অবোধরা কোথায় লুকিয়ে আছে বা কোন চৌমাথার মোরে দাঁড়িয়ে গোমাংস ভক্ষণ করে অসাম্প্রদায়িকতা দেখাচ্ছেন তা জানতে ইচ্ছা করে।
অনেক শুনে নিয়েছি ভাষা নদীর মতন আপন বেগে বয়ে চলে। যুগে যুগে বহিরাগতরা এসেছে আর আমাদের সংস্কৃতি ও পরম্পরাকে নিয়ে, আমাদের ভাব ও ভাবনা নিয়ে খেলা করে গেছে। অনেক হয়েছে চাপান উতরান। এখন আমরা স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে। আমরা কোন উপনিবেশের অধীনে নেই, তবে কেন অন্য কোন বৃহৎ ভাষার অধিকরণ মেনে নেব আমরা ?
রবীন্দ্রনাথ বাঙলা বানানের সরলীকরণ করে গেছেন কিন্তু তার তৎসম তদ্ভব ভাব অক্ষয় রেখে । অক্ষর গুলি এক একটা মূর্তি। মা কালীর মুন্ডমালার প্রতিটি মুন্ডই এক একটা অক্ষর।
যে ভাষার জন্য শিলচর বা মানভূমে বা দাঁড়িভিটায় ভাষাবীররা প্রাণ দিয়েছেন, যে বাঙ্গলা ভাষায় বাউলরা গান গায়, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলে গেছেন “মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধের ন্যায় “” ; সেই ভাষার আরবিকরণ আমরা মেনে নেওয়া মানে মাতৃদুগ্ধেও ভেজাল মেলানো !!! এতই কি খারাপ দিন এসে গেছে আমাদের? আজ আর কোন বঙ্কীম চন্দ্রর মুখ থেকে বেরবেনা ভাষাদেবীর এই অন্ধকারময় রূপের বর্ণনা। কারণ আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কলম বিকিয়ে গেছে। আমাদের মাটির মতই আমাদের ভাষাও আজ পরদস্যুকবলিত। তাই আজ মনে প্রশ্ন ওঠে-
নীড়হারা পাখি দিশা হারিয়েছে
সিমানা পেরিয়ে যাবে কার কাছে ?
বাঙ্গলার গান বাঙালীর ভাষা
দিগন্তে মিশে যায় ।।
এর শেষ কোথায় ????
উত্তর দেবে কে ????