🚩 জয় মহাকাল 🚩
© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
পর্ব : ১২ ( শ্রী গৃস্নেশ্বর )
ঔরঙ্গাবাদ
দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্তিম বা শেষ জ্যোতির্লিঙ্গ হল
শ্রীগৃস্নেশ্বর বা ঘুশ্মেশ্বর । এই জ্যোতির্লিঙ্গ মহারাষ্ট্রের দৌলতাবাদ থেকে বারোমাইল দূরে বেরুলগাঁয়ের কাছে অবস্থিত । কারো কারো মতে এই জ্যোতির্লিঙ্গ সবচেয়ে প্রাচীন। যে স্থানে এই জ্যোতির্লিঙ্গ অবস্থিত সেই স্থানে আদিম যুগের মানুষের বাস ছিল। এইখানে বসবাসকারী মানুষ প্রথম তামার ব্যবহার শিখেছিল, এবং বিভিন্ন ধাতু মিশিয়ে তৈরি করেছিল পিতল। তাই এই স্থানটির নাম
পিতলখোড়া। বন জঙ্গলে ভরা পিতলখোড়া পাহাড়ের মাথায় একটি ঝর্ণা রয়েছে। এই ঝর্না থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে পূর্ণা নদী । এর খুব কাছেই অবস্থিত ভারত বিখ্যাত ইলোরা গুহা মন্দির।
পুরাণে এই জ্যোতির্লিঙ্গ প্রসঙ্গে কথিত আছে যে দক্ষিনে দেবগিরি পর্বতের ( ঔরঙ্গাবাদ এর কাছে অবস্থিত দেবগিরি। মুহাম্মদ বিন তুঘলক এই দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন আর দেবগিরি নাম বদল করে নাম রাখেন দৌলতাবাদ) কাছে সুধর্মা নামে এক অত্যন্ত তেজস্বী তপনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তার পত্নীর নাম ছিল সুদেহা। উভয়ের মধ্যে গভীর প্রীতির সম্পর্ক থাকলেও তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। সেই দুঃখে বড় দুঃখী ছিলেন
সুদেহা। জ্যোতিষ গণনা করে দেখা গিয়েছিল সুদেহার গর্ভে সন্তান হওয়া সম্ভব নয় ,কিন্তু তাঁর খুবই সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই তিনি তার কনিষ্ঠা ভগিনীর সঙ্গে সুধর্মার বিবাহ দিলেন।
ব্রাহ্মণ শুধর্মার এই বিবাহতে খুব একটা সম্মতি ছিল না, কিন্তু পত্নীর জেদের কাছে তিনি মদ বদল করেন এবং পত্নীর ছোট বোন সুষমা ঘুষ্মাকে বিবাহ করেন।
সুষমা ছিলেন পরম শিব ভক্ত। শিবপূজা না করে কোনদিন তিনি জল গ্রহণ করতেন না। তিনি নম্র এবং সদাচারী নারী ছিলেন। প্রত্যহ একটি মৃন্ময় শিবলিঙ্গ তৈরি করে তিনি শ্রদ্ধা সহকারে শিবের পূজা করতেন। ভগবান শিবের কৃপায় কিছুদিন বাদেই তাঁর গর্ভে এক সুন্দর, স্বাস্থ্যবান পুত্র জন্ম নেয়। বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করাতে সুদেহা এবং সুষমা উভয়েরই আনন্দের সীমা রইল না ।আর উভয়ই অত্যন্ত সুখে দিন কাটাতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে সেই সুন্দর পুত্র সন্তান বড় হয়ে গেল। সুধর্মা একদিন তার বিবাহ দিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে সুদেহার মনে এক চিন্তার উদয় হল। তিনি ভাবতে লাগলেন এই গৃহে তাঁর আপন বলে কিছুই নেই। স্বামী, পুত্র সবই তাঁর বোন সুষমার। ক্রমশ তাঁর মনে এই কুচিন্তা বিস্তার লাভ করল। একদিন কুচিন্তার অঙ্কুর মহীরুহের আকার ধারণ করল। তিনি একদিন সুষমার পুত্র সন্তানকে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করলেন। সেই মৃতদেহ তিনি একটি পুকুরে ফেলে দিলেন। এই পুকুরের সুষমা প্রতিদিন শিব পূজার পর শিবলিঙ্গগুলি বিসর্জন দিতেন।
সকাল হতেই সকলে এই খবর জেনে গেল। গৃহ বিষন্নতায় ভরে গেল। সুধর্মা এবং তাঁর পুত্রবধূ মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলেন, কিন্তু সুষমা প্রতিদিনের মতো সেদিনও শিব পূজায় নিমগ্ন রইলেন, যেন কিছুই হয়নি। পূজা সমাপ্ত হলে তিনি সেই পুকুরে গেলেন মাটির শিব বিসর্জন দিতে। তিনি যখন শিবলিঙ্গ বিসর্জন দিয়ে উপর থেকে ফিরে আসছেন, তখন দেখা গেল তাঁর প্রিয় পুত্র পুকুর থেকে উঠে আসছে। সে রোজকার মতন এসে সুষমার চরণে প্রণাম করল, যেন কাছেই কোথাও ছিল।
সেই সময় সেই স্থানে আবির্ভূত হলেন দেবাদিদেব। তিনি সুষমাকে বর প্রার্থনা করতে বললেন এবং সুদেহার এই ঘৃণ্য কার্যের জন্য তাঁর ত্রিশূল এর সাহায্যে সুদেহার গলা কাটতে উদ্যত হলেন। কিন্তু সুষমা হাতজোড় করে ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলেন:
“প্রভু আপনি যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে আমার এই অভাগিনী বোনকে ক্ষমা করে দিন। সে অত্যন্ত জঘন্য কাজ করেছে, কিন্তু আপনার দয়ায় আমি আমার পুত্রকে ফিরে পেয়েছি ।অতএব আপনি একে ক্ষমা করুন। “
সেই সঙ্গে তিনি আরও একটি প্রার্থনা করলেন যে দেবাদিদেব যেন লোক- কল্যাণের নিমিত্তে এই স্থানে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে চিরকাল অবস্থান করেন।
সুষমার প্রার্থনায় খুশি হয়ে দেবাদিদেব সুদেহাকে ক্ষমা করলেন এবং এই স্থানে শ্রী
গৃস্নেশ্বর বা ঘুস্মেশ্বর রূপে চিরকাল জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে অবস্থান করতে লাগলেন। শিবভক্ত সতী সুষমার আরেক নাম ঘুষ্মা । তাই এখানে জ্যোতির্লিঙ্গের নাম শ্রী ঘুস্মেশ্বর ।
এই জ্যোতির্লিঙ্গ দীর্ঘকাল রোদ ঝড় জলে দাঁড়িয়ে থেকেছেন বছরের পর বছর অবহেলিত হয়। শেষ পর্যন্ত রানী অহল্যা বাই এর চেষ্টায় তৈরি হয় গৃস্নেশ্বর এর মন্দির।
এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির এর খুব কাছেই অবস্থিত
ইলোরার গুহা মন্দির। গুহা মন্দির তৈরি করা ভারতের এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তি। ইলোরা গুহা মন্দির গুলির মধ্যে প্রথম তেরোটি গুহা মন্দির বৌদ্ধদের। তারপরের ১৬ টি হিন্দুদের আর শেষ পাঁচটি জৈন গুহামন্দির। এই গুহা মন্দির গুলো তৈরি করা শুরু হয় সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে। কাজ চলে এক হাজার বছর ধরে। সমস্ত গুহা মন্দির গুলির মধ্যে সবথেকে পুরানো বৌদ্ধ মন্দির গুলি। আর শ্রেষ্ঠ হল ১৬ নম্বর গুহা বা কৈলাস মন্দির।
প্রতি বছর অনেক পর্যটক ইলোরা মন্দির দর্শন করতে আসেন, কিন্তু এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি জনের নেই। তবে প্রতিবছর শিবরাত্রির সময় এখানে মস্ত বড় মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে আসেন এবং তখন এই স্থান গমগম করে। পুরাণে গৃস্নেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের মহিমা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন করলে ইহলোক পরলোক উভয় স্থানেই ফল অমোঘ হয়।
🚩 হর হর মহাদেব🚩
তথ্যসূত্র :
১. শিব ঠাকুরের বাড়ি- সোমনাথ। দেব সাহিত্য কুটির।
২. ওঁ্ নমঃ শিবায় : গীতা প্রেস। গোরক্ষপুর।