© অমিত মালী
৫০০ বছরের ইসলামিক শাসন দেখেছে বাংলা, ভালোকরে বললে অবিভক্ত বাংলার বাঙালি প্রত্যক্ষ করেছে ইসলামিক শাসন। এই কয়েকশো বছরের ইসলামিক সামনে বাঙালি হারিয়েছে তাঁর অনেক মন্দির, অনেক পবিত্র তীর্থস্থান এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। সেইসঙ্গে হারিয়েছে তাঁর অতীত গৌরবকে। শুধু তাই নয়, বাঙালি তাঁর পরের প্রজন্মের কাছে সেই ইতিহাসকে পৌঁছে দেয়নি। এইরকম একটি ইতিহাস হলো বালিয়া-বাসন্তীর ইতিহাস, যা বর্তমানে ফুরফুরা শরীফ নামে পরিচিত।
ফুরফুরা শরীফ বর্তমানে হুগলি জেলার অন্তর্গত জাঙ্গিপাড়া ব্লকে অবস্থিত। এটি সারা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এটি একটি হিন্দু রাজার রাজধানী ছিল , যা মুসলমান সেনারা আক্রমণ করে দখল করে এবং ফুরফুরা শরীফের নাম দেয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস।
বাংলায় তখন সুলতানি শাসন। ইসলামিক রাজত্বে তখন বাংলার আপামর হিন্দুর তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাংলা শাসন করছেন শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ । শামসুদ্দিন সেনাপতি জাফর খান ও তাঁর মুসলমান সেনাবাহিনী একের পর এক হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। এই যুদ্ধ ঘোষণা একটু বিস্তারিত বলা দরকার। প্রতি সুলতানি সেনার সঙ্গে অনেক মাওলানা, সুফী সাধক এবং ইসলাম প্রচারক থাকতেন। এরা সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন এবং হিন্দু জনগণকে ইসলামে ধর্মান্তকরণের চেষ্টা চালাতেন। এছাড়াও হিন্দু রাজাদের অধীনে থাকা রাজ্যে ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করে ইসলামিক শাসকদের দিতেন। অনেকসময় এই সুফী সাধকরা হিন্দু রাজাদের সরাসরি ইসলামে ধর্ম গ্রহণ করার ‛দাওয়াত’ দিতেন। যদি সেই রাজা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অসম্মত হতেন, তাহলে এই সুফী সাধকরা সেই হিন্দু রাজার রাজ্য আক্রমণ করার জন্য উৎসাহ দিতেন। ঠিক এইরকম ঘটনা শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছিলো। তিনি একজন সুফী সাধকের ভক্ত ছিলেন, যার নাম ছিল হযরত শফিউদ্দিন শহীদ ওরফে শাহ সুফী সুলতান। এছাড়াও ছিলেন সৈয়দ হুসেন বুখারী, যারও কথা মেনে চলতেন শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ । এই দুজন সুফী সাধক শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহকে বালিয়া-বাসন্তী আক্রমণ করার জন্য বলেন। কারণ ওই একই। রাজাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার দাওয়াত দেওয়া হলেও গ্রহণ করেননি বালিয়া বাসন্তীর হিন্দু রাজা। ফলে ওই দুজন সুফী সাধক বালিয়া -বাসন্তী আক্রমণ করার জন্য শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহকে প্ররোচিত করেন।
কেমন রাজ্য ছিল বালিয়া-বাসন্তী রাজ্য? কেমন ছিলেন এর রাজা? ফুরফুরা শরীফ থেকে প্রকাশিত এবং হযরত মাওলানা আবু জাফর সিদ্দিকী সাহেব-এর লেখা ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস বইতে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। বালিয়া-বাসন্তী ছিল একটি ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য। আশেপাশের মানুষজনের কাছে এটি বাগদি রাজার গড় নামে পরিচিত ছিল। তবে রাজার গড়ে একটি পবিত্র পুকুর ছিল, যে চন্দ্র পুকুর নামে বিখ্যাত ছিল। তাঁর রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ তথাকথিত দলিত অর্থাৎ নিম্নবর্ণের হিন্দু ছিল। রাজার নাম কি ছিল, তা জানা যায়না। তবে অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক অনুমান করেন যে রাজার নাম চন্দ্র মোহন কিংবা চন্দ্রনাথ ছিল। রাজা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তিনি রোজ তাঁর গড়ের পবিত্র পুকুরে স্নান করে কুলদেবী মা কালীর পূজা করতেন। সেইসঙ্গে তিনি সাধু-সন্ন্যাসীকে অত্যন্ত ভক্তি করতেন। তাঁর গড়ে কোনো সাধু সন্ন্যাসী এলে তার আতিথেয়তার কোনো ত্রূটি করতেন না এবং তিনি নিজে তাদের সেবা করতেন।
১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে জাফর খান গাজী এবং সৈয়দ হুসেন বুখারীর নেতৃত্বে মুসলিম সৈন্য বালিয়া-বাসন্তী দখল করার উদ্দেশ্যে অভিযান করেন। জাফর খান কিছুদিন আগেই পাণ্ডুয়া এবং সপ্তগ্রাম জয় করেছেন। ফলে তাঁর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ছিল। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী বাগদি রাজার গড়ের বাইরে শিবির স্থাপন করেন। তিনি আশা করেছিলেন যে রাজা বহু সংখক মুসলিম সেনাবাহিনী দেখে বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হলো না। পরেরদিন সকালেই বাগদি রাজা চন্দ্রমোহন জাফর খানের বাহিনীকে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে সংখ্যায় কম থাকা বীর বাগদি সেনাদের আক্রমণে মুসলমান সেনাদের তখন পালাই পালাই অবস্থা। প্রথমদিনের যুদ্ধে বাগদি রাজার সেনা এবং মুসলমান সেনা বাহিনীর অনেকেই হতাহত হয়।
পরেরদিন আবার যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা লক্ষ্য করলো যে গতকালের তুলনায় আজ বাগদি রাজার সৈন্য সংখ্যা বেশি এবং দ্বিগুন বীরত্বের সহিত বাগদি রাজার সৈন্য যুদ্ধ করছে। দ্বিতীয়দিনের যুদ্ধে বহু মুসলিম সৈন্য শহীদ হলো। শহীদ হলেন শাহ সুফী সুলতানের অত্যন্ত প্রিয় শাহ সুলেমান। পরেরদিন সুলতানের সৈন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করলো। তারা তাদের কিছু সংখক সৈন্যকে একটি আলাদা দলে ভাগ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন বাগদি রাজারা গড়-এর আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলিকে আক্রমণ করার। সেই নির্দেশ অনুযায়ী মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণে আশেপাশের বহু হিন্দু গ্রাম ধ্বংস হয়। আর একটি সৈন্যদল হিন্দু রাজার সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু সেদিনের যুদ্ধেও জাফর খান-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সৈন্য বালিয়া-বাসন্তী গড় জয় করতে পারেননি।
(ক্রমশঃ)