© তপন ঘোষ
২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশে সােনিয়া মনমােহনের সরকার ছিল । সােনিয়া মনমােহন বলতে যন্ত্ৰী আর যন্ত্র বােঝায় এটা দেশের মানুষ জানে । কিন্তু সােনিয়া মনমােহন নাম দুটি দিয়ে ওই ইউপিএ সরকারের সঠিক চরিত্রটা বােঝা যায় না । সেটা বুঝতে হলে — সােনিয়া , মনমােহন , দিগ্বিজয় , কপিল সিব্বল , সলমন খুরশিদ নামগুলি একসাথে উচ্চারণ করতে হবে । এদের সকলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত হিন্দু বিদ্বেষে পরিপূর্ণ এবং সমস্ত হিন্দু সংগঠনগুলির এরা ঘােষিত শক্র । এদের দশ বছরের জমানায় এশিয়াড কেলেঙ্কারী , 2G কেলেঙ্কারী , কয়লা খনি বন্টন কেলেঙ্কারী , প্রভৃতি বড় বড় অবদানগুলির সঙ্গে দেশের মানুষ ভালােভাবেই পরিচিত হয়েছে । কিন্তু এই জমানায় আর একটি বড় অবদানের কথা আমি পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই । তা হল “ গেরুয়া সন্ত্রাস ” বা Saffron Terror ।
২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর আমেরিকায় নিউইয়র্ক শহরে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে লাদেন অনুগামীদের বিমান হানার পর থেকেই গােটা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ও ইসলাম শব্দদুটি একসঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল । “ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ ” সাধারণ মানুষের কাছে সহজবােধ্য হয়ে সর্বসাধারণের আলাচনার বিষয় হয়ে পড়েছিল । গােটা বিশ্বের শিশুরাও ইসলাম আর সন্ত্রাসবাদ কথা দুটি একসঙ্গে শুনতে শুনতে বড় হচ্ছিল । ফলে সন্ত্রাসবাদ মানেই ইসলাম আর ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ — এটা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়েছিল । গােটা বিশ্ব ইসলামকে সন্ত্রাসবাদী ধর্ম অথবা সন্ত্রাসবাদীদের ধর্ম অথবা সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেওয়ার ধর্ম হিসাবেই দেখছিল । এখনও তাই দেখছে । লাদেন ও আলকায়দার পর আই এস আই এস ( ISIS ) , IS , ISIL ইত্যাদির উত্থানে ওই ধারণা আরও মজবুত হয়েছে । কিন্তু ব্যতিক্রম ভারত । ভারতের থেকে ইসলামের বড় মুরুব্বি বিশ্বে আর কেউ নেই । এমনকি সৌদি আরব , আরব আমিরশাহী প্রভৃতি দেশগুলিও নয় । লাদেনের জন্য জানাজার নামাজ কোন আরব দেশে পড়া হয়নি । কিন্তু আমাদের ভারতে , আমাদের এই কলকাতার কেন্দ্রস্থলে ইমাম বরকতির নেতৃত্বে লাদেনের জানাজার নমাজ পড়া হয়েছিল । ওই ইমামের সঙ্গে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর বহু ছবি জনসাধারণের কাছে পরিচিত ।
সুতরাং গােটা বিশ্ব ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমার্থক বলে জানলেও ভারতের মানুষের মধ্যে , বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের মধ্যে যাতে ওই ধারণা ঢুকে না যায় , তার জন্য ইসলামের মুরুব্বিরা যে অতি সক্রিয় হবেন এটা তাে স্বাভাবিক । তাদের সেই সক্রিয়তা বাস্তবে রূপ পেল সােনিয়া – মনমােহন পরিচালিত ইউপিএ সরকারের দ্বারা । ওই সরকারের দর্শন ফুটে উঠেছিল দু’জনের কথায় । ( ১ ) মনমােহন সিং বলেছিলেন , দেশের উন্নয়নের প্রথম ভাগ / অগ্রভাগের অধিকারী ভারতের মুসলমানরা । ( ২ ) রাহুল গান্ধী বলেছিলেন , ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ( হিন্দু ) সন্ত্রাসবাদ সংখ্যালঘু ( মুসলিম ) সন্ত্রাসবাদের থেকেও ভয়ঙ্কর । এই যাদের মতামত , তাদের কর্মধারা কিরকম হবে তা বােঝা কঠিন নয় । তাদেরকে JNU- এর তাত্ত্বিকরা দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বা মুসলিম সন্ত্রাসবাদকে ভারতবাসীর কাছে লঘুকরে দেখাতে হবে । এইকাজ করতে সােনিয়া-মনমােহনের সরকার যে কতদূর গিয়েছিল , তার কথা হয়তাে দেশবাসী কোনদিন জানতে পারবে না । কোন বিশেষ ঘটনাসূত্রে তার কিছু কিছু কথা আমার জানার সুযােগ হয়েছিল । তা জেনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওই সরকারের হিন্দু বিরােধী মানসিকতা ও হিন্দুবিরােধী ষড়যন্ত্রের গভীরতা দেখে । ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে লঘু করে দেখানাের জন্যই এরা আমদানী করেছিলেন গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ নামক শব্দটিকে। তাই শুরুতেই বলেছি যে , এশিয়াড -2 G- কয়লাখনি স্ক্যামের মতই ইউপিএ সরকারের আর একটি বড় অবদান হল এই গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ শব্দটির আমদানী ।
গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ কথাটা চালু হয়ে গেলে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আর শুধু ইসলাম কথাটা জোড়া যাবে না । তখন “ সন্ত্রাসবাদের কোন ধর্ম হয় না ” কথাটা বলতে সুবিধা হবে । গােটা পৃথিবী জানে সন্ত্রাসবাদের ধর্ম , সন্ত্রাসবাদীর ধর্ম , সন্ত্রাসবাদীর জন্ম দেওয়ার ধর্ম — সবই এক । তা হল ইসলাম । গােটা পৃথিবী You Tube- এ দেখছে কোতল করা সময় , জবাই করার সময় , গুলিতে ঝাঝরা করে দেওয়ার সময় কি নিষ্ঠা সহকারে কোরানের আয়াত পাঠ করা হচ্ছে , আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেওয়া হচ্ছে । সুতরাং মানুষের বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে । কিন্তু ভারতবাসীর জানা ও বােঝাটাকে অন্যরকম করার জন্য আসরে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ইউপিএ সরকারের কুশীলবরা । তাদের হাতে সবথেকে বড় অস্ত্র গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ , স্বামী অসীমানন্দ ও সাধ্বী প্রজ্ঞার ছবি ।
কংগ্রেসীরা গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ কথাটির জন্ম দিয়েছে । আমিও তেমনি একটি শব্দযুগল / জোড়া শব্দ ব্যবহার করতে চাই । ব্যবহার না করে পারছি । তা হল “ গেরুয়া ধর্মনিরপেক্ষতা ” বা- Saffron Secularism ” । আমি জানি আমার এই কথা শুনে অনেকে রে রে করে উঠবেন , আমাকে গালাগালি করবেন , অভিশাপ দেবেন । কিন্তু আমি মনে করি আজকে সময় এসেছে এই শব্দটি চালু করার গেরুয়া ধর্মনিরপেক্ষতা ।
আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে হিন্দুত্ববাদী লেখক শিবপ্রসাদ রায় এ বিষয়টি শুরু করেছেন , কিন্তু এই শব্দটি তিনি ব্যবহার করেন নি । তিনি বলেছিলেন , দিব্যজ্ঞান যুক্ত কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানহীন সাধু সন্ন্যাসীদের কথা । কিন্তু আজ সময় এসেছে আরও কঠোরভাবে বলার । তাই আমি এই শব্দ শুরু করছি । কেন আমাকে এটা করতে হচ্ছে তা সামান্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি ।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতা – মন্ত্রীদের খুবই দাপট । পৃথিবীর কোন উন্নত ধনী গণতান্ত্রিক দেশে এতটা দাপট নেই । কোন দেশেই নেতা মন্ত্রীদের জন্য রাস্তার ট্রাফিক দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয় না । এদেশের সাধারণ মানুষ নেতা – মন্ত্রীকে খুবই সমীহ করেন । অথবা করতে হয় । কিন্তু বাড়ির ভিতরে নিজের পরিবারের মধ্যে কেউ কখনও ছােটদেরকে এই উপদেশ দেয় না , খােকা তুমি বড় হয়ে রাহুল গান্ধীর মত হওয়ার চেষ্টা কর , কিংবা গৌতম দেবের মত হওয়ার চেষ্টা কর বা মদন মিত্রের মত হওয়ার চেষ্টা কর । অর্থাৎ এইসব নেতাদেরকে সাধারণ মানুষ যতই ভয় বা সমীহ করুক না কেন , নিজ সন্তানের সামনে তাদেরকে কখনও আদর্শ হিসাবে তুলে ধরে না । তাহলে এই সব নেতাদের লেকচার , উপদেশ বা বচনামৃতকে সাধারণ মানুষ মন থেকে গ্রহণ করবে — তা তাে সম্ভব নয় ! মমতা ব্যানার্জী রামকৃষ্ণ মিশনের গেরুয়াধারী অসুস্থ সন্ন্যাসীকে দেখতে যাচ্ছেন , তার পরেই আবার মাথায় হিজাব টেনে আল্লা আল্লা করছেন — এই দেখে সাধারণ মানুষ হিন্দু মুসলমানকে সমান বলে ভাববে কি ? আমি মনে করি—না । ভাববে না । মানুষ খুব ভাল করেই জানে , রাজনীতিবিদদের নাটক করতে হয় । তাই মমতা ব্যানার্জীর রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়াও নাটক , আর হিজাব পড়াও নাটক । আমার দৃঢ় মত , সাধারণ মানুষ কখনই রাজনৈতিক নেতা – মন্ত্রীদের কাছ থেকে কোন সামাজিক বা ধর্মীয় আদর্শ বা প্রেরণা গ্রহণ করে না ।
তাহলে আমাদের সমাজে যে বিকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বিষাক্ত বীজ ঢুকে গিয়েছে তার জন্য তাে নেতা – মন্ত্রীরা দায়ী হতে পারেন না । সমাজের মানুষ ওদের কথা তাে মন থেকে গ্রহণ করে না । তাহলে কোথা থেকে এলাে এই বিষ ? কারা ছড়ালাে এই বিষ ? আমরা ধারণা সমাজে এই বিষ ছড়ানাের জন্য দায়ী গেরয়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বা Saffron Seculerist- রা । আরও সহজ করে বললে ধর্মীয় সেকুলারিস্টরা ।
আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এর শুরু হয়েছে সম্ভবতঃ আমাদেরই বঙ্গপ্রদেশ থেকে । যাঁর নাম দিয়ে শুরু হয়েছে তিনি হলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব । আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি , তিনি শুরু করেন নি । তাঁর নাম দিয়ে শুরু হয়েছে । “ যত মত তত পথ ” ঠাকুরের এই উক্তিটিকে সম্পূর্ণ ভ্রান্তভাবে প্রয়ােগ যাঁরা করেছেন , অর্থাৎ রামকৃষ্ণ মিশন এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী । ঠাকুর এই কথাটি হিন্দুধর্মের বা ভারতীয় ধর্মের মধ্যে যে বহু মত , পন্থ ও সম্প্রদায় আছে , তাদের জন্য বলেছিলেন । রামকৃষ্ণ মিশন সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে এর মধ্যে ইসলামকে এবং খ্রীস্টান ধর্মকেও ঢুকিয়ে দিল । হ্যাঁ এটা মিথ্যাচার । যত মত তত পথ – এর মধ্যে খ্রীস্টান , ইসলাম বা কোন সেমেটিক ধর্ম আসতে পারে না । ওই ধর্মগুলাে খুব স্পষ্টভাবে বলেছে যে , তাদের পন্থাটাই একমাত্র সত্য , বাকি সব পন্থা মিথ্যা । এবং সেই মিথ্যা পন্থের অনুগামীরা গড্ বা আল্লাহ দ্বারা ধিকৃত ও নিন্দিত এবং ওই অনুগামীদের জন্য নরকের দ্বার প্রশস্ত । অর্থাৎ তারা শুধু নিজেরটাকেই ঠিক বলছে না , অন্যেরগুলােকে ভুল বলছে । এটাকে যদি সত্য বলে মেনে নিই , তাহলে তাে অন্য মতগুলােকে মিথ্যা বলে মানতে হবে । তাহলে “ যত মত তত পথ ” কিভাবে সত্য হতে পারে ? একটি মাত্র মতকে সত্য এবং অন্য সব মতকে মিথ্যা বলে যারা মানে – তারা যত মত তত পথ ” -এর আওতায় কী করে আসতে পারে ? একটু গভীরভাবে ভাবার জন্য আমি পাঠককে অনুরােধ করছি ।
রামকৃষ্ণদেব ভাগ্নে হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে মাইকেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারেন নি । বেরিয়ে এসে । ভাগ্নের ক্ষোভের উত্তরে বলেছিলেন — মা কালী তার জিভ টেনে ধরেছিল বলে তিনি কথা বলতে পারেন নি । রামকৃষ্ণদেব যদি খ্ৰীষ্টি মতটাকে সত্য বলে মনে করতেন তাহলে কি এই ঘটনা ঘটত ?
ঠাকুর নাকি ইসলামের সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছিলেন । সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা । এটা হতে পারে । তিনি নাকি ইসলামে দীক্ষা নিয়েছিলেন কোন একজন সুফী সাধক গােবিন্দ রায়ের কাছ থেকে । গােবিন্দ রায় নিজেই মুসলমান ছিলেন না । কলমা পড়েন নি । তিনি কী করে রামকৃষ্ণদেবকে ইসলামে দীক্ষা দেবেন ? এ বিষয়ে আরও অনেক কথা লেখা যায় । কিন্তু তা বিরক্তিকর । রামকৃষ্ণের ইসলাম সাধনা ও সিদ্ধিলাভ বিষয়টা জন মনে বিশ্বাসযােগ্য হওয়ার পিছনে আমি স্বামী বিবেকানন্দের একটা ভুল দেখতে পেয়েছি । আমার একথা শুনে কেউ যদি ক্ষেপে যান , আমি নিরুপায় । স্বামীজী রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন । অলৌকিকভাবে পৃথিবীতে অবতরণ করেন নি । আর সকলের মত তিনিও মাতৃগর্ভ দিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন । সুতরাং তাঁর হাত দিয়ে একটাও ভুল হবে — এটা যুক্তি দিয়ে মানা যায় না । আমার থেকে স্বামীজীর বড় ভক্ত আর কেউ আছে কি না জানি । স্বামীজীর আর কোন ভুল আমার চোখে পড়ে নি । কিন্তু এই একটা ভুল আমার চোখ এড়িয়ে যায় নি । সেই ভুলের কথা পাঠকের কাছে তুলে ধরা কর্তব্য বলে আমি মনে করছি ।
ঠাকুরর কথা , বাণী বা উপদেশের সবথেকে বড় সংকলন করেছেন ঠাকুরের গৃহীভক্ত শ্ৰীম বা মাস্টারমহাশয় , তাঁর লেখা রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থে । এটাকে রামকৃষ্ণ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর গ্রন্থ হিসাবে মনে করা হয় । কিন্তু ওই একই সময় ঠাকুরের আর একজন গৃহী ভক্ত অক্ষয়চন্দ্র সেন , যাকে স্বামীজী আদর করে ‘শাঁকচুন্নি ‘ বলে ডাকতেন , তিনি একটি পদ্যে বই লিখেছেন ঠাকুরের জীবনী নিয়ে । পুরােনাে ধাচে বােধ হয় পয়ার ছন্দে লেখা ঐ বই । নাম “ শ্রীরামকৃষ্ণ ” পুঁথি । যেহেতু ওই লেখক ঠাকুরের সমসাময়িক এবং ভক্ত , তাই তাঁর লেখাও আকর গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছিল । স্বামীজী তাে এক অসাধারণ পাঠক ছিলেন , সেকথা আমরা অনেক গল্পের মাধ্যমে জানি । কিন্তু একজন স্বামীজী ভক্ত হিসাবে তাঁর যে রুচি , টেম্পারমেন্ট আমি বুঝি , তাতে আমি নিশ্চিত যে ওই ইনিয়ে বিনিয়ে পুরানাে বাংলায় পদ্যের ছন্দে লেখা গােটা গ্রন্থটি স্বামীজী পড়েন নি । কিন্তু অক্ষয় সেন ঠাকুরের জীবনী লিখেছেন বলে না পড়েই তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে দিয়েছিলেন । এতেই হয়ে গেল সর্বনাশ । স্বামীজীর এই প্রশংসার ফলে ‘ শাকচুন্নির ‘ লেখা ওই গ্রন্থটি প্রামাণ্য আকর গ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে গেল । একমাত্র এই বইটিতেই ওই আজগুবি ঘটনাটা আছে যে , গঙ্গায় মরা গরু ভেসে যেতে দেখে ঠাকুরের গােমাংস খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল । যুক্তি বলে — ইসলামের সঙ্গে গােমাংস খাওয়ার কী সম্বন্ধ ? ইসলামের জন্মস্থান আরবে কি গরু পাওয়া যায় ? মহম্মদ গােমাংস খেতেন এরকম উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না । ওখানে সাধারণ মানুষের । খাদ্য ভেড়ার মাংস ও উটের মাংস । কখনও গােমাংস নয় ? ভারত আক্রমণকারী বহিরাগত মুসলমানরা যখন দেখল যে হিন্দুরা গরুকে খুব বেশি রকমের শ্রদ্ধা করে , তখন সেই শ্রদ্ধাস্থানকে আঘাত দেওয়ার জন্যই ওরা গােহত্যা করা শুরু করেছিল । এতে প্রতিহিংসা আছে , শক্রর মনােবল ভাঙার কৌশল আছে । কিন্তু তার সঙ্গে ইসলামের কোন ধর্মীয় বা পন্থীয় সম্পর্ক নেই । তাই ঠাকুর যখন ইসলাম মতে সাধনা করছেন , তখন তাঁর গােমাংস খেতে ইচ্ছা হয়েছে — এটা মিথ্যা । এটা আমি মানি না । স্বামীজী ওই রামকৃষ্ণ পুঁথি দু’চার পাতা পড়েই অক্ষয় সেনের গুরুভক্তি দেখে তার প্রশংসা করেছিলেন । এই অংশটি পড়েন নি । পড়লে নিশ্চিতভাবে লেখককে তিরস্কার করতেন । ও ওই জায়গাটা সংশােধন করতে বলতেন । তা হয় নি । তাই সেখান থেকেই শুরু হয়ে গেল ইতিহাসের একটা এত বড় ভুল ।
এছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম ও সংস্থাগুলিতে ক্রিসমাস বা বড়দিন উৎসব আকারে পালন করা দেখেও মনে ধন্দ জাগে । এটাকে যদি কেউ “ যত মত তত পথ ” তত্ত্বের প্রমাণ বা পরিপূরক বলে দেখাতে চান , তাহলে সহজেই প্রশ্ন করা যায় যে ক্রিসমাস পালিত হলে ঈদ কেন নয় ? গরু কাটা ঈদ যদি বা না হয় , খুশীর ঈদ ( ঈদ উল ফিতর ) কেন রামকৃষ্ণ মিশনে পালন করা হয় না ? ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার সময় অখণ্ড ভারতে ক’টা খ্রীষ্টান ছিল আর ক’জন মুসলমান ছিল ? খ্রীষ্টানের থেকে মুসলমান অনেক অনেক বেশি ছিল । যত মত তত পথের বাস্তব রূপায়ণ করতে হলে মিশনে ক্রিসমাসের থেকেও ঈদ পালন করাটা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত হতে না কি ? ঈদ কেন নয় । কেন শুধু ক্রিসমাস ? পাঠক যদি এর উত্তর খুঁজে না পান , তাহলে আমার উত্তরটা বিবেচনা করে দেখতে পারেন । স্বামীজীর বহু সাহেব ও খ্রীষ্টান শিষ্য হয়েছিল । স্বামীজী আমেরিকায় ও ইংল্যান্ডে অনেকগুলি স্থানে মিশনের শাখাকেন্দ্র শুরু করেছিলেন । কোন মুসলিম দেশে করেন নি । কোন মুসলমান তাঁর শিষ্য হয়নি । সাহেবরা শুধু শিষ্যই হয় নি , বেলুড় মঠ তৈরির জন্য তারা প্রভূত অর্থ সাহায্য করেছিল । আর হিমালয়ের কোলে মায়াবতী আশ্রম তাে সম্পূর্ণ তাদেরই পয়সায় তৈরি হয়েছিল । এই সাহেব ও খ্রীষ্টানদের কাছে বড়দিন বা ক্রিসমাস তাে সবথেকে বড় উৎসব এবং তা তাদের কাছে একটা বিরাট ব্যাপার । স্বামীজী তাে হিন্দুধর্মের প্রবক্তা ও মূর্ত রূপ ছিলেন । হিন্দু ধর্মের Inclussiveness এর কথা তিনি খুব বেশিভাবে ও জোর দিয়ে প্রচার করেছেন । তাই তাঁর খ্রীস্টান সাহেব শিষ্যদের প্রিয় উৎসব বড়দিনকে তার মঠে পালন করে তিনি হিন্দুধর্মের ওই Inclussiveness এরই পরিচয় দিয়েছেন । পাঠক লক্ষ্য করে দেখুন- এতে কিছুটা তত্ত্ব , কিছুটা বাস্তবতা । শিবপ্রসাদ রায়ের ভাষায় দিব্যজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান একাধারে ।
শুধু বড়দিন পালনই নয় । যীশু খ্রীস্টের শৈলােপাদেশের উপরেও স্বামীজী শিষ্যদের ক্লাস নিয়েছেন । যীশুখ্রীস্টের ভালবাসা ও করুণার বাণীকে শিষ্যদের সামনে তুলে ধরতে স্বামীজী একটুও দ্বিধা করেন নি । কিন্তু তাই বলে কাউকে তিনি খ্রীস্টান ধর্ম নিতে উৎসাহ দেন নি । বরং যজ্ঞ করে , শুদ্ধি করে বহু খ্রীস্টানকে হিন্দু করেছেন । স্বামীজীর স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিল যে , যীশুখ্রীস্টের বাণী ও প্রাতিষ্ঠানিক খ্রীস্টধর্ম এক নয় । গােটা Old Testament- টাই তাে যীশুখ্রীস্টের বাণী নয় । কিন্তু তা খ্রীস্টধর্মের অনিবার্য অঙ্গ । সুতরাং মিশনে বড়দিন পালনকে “ যত মত তত পথ ” -এর অভ্রান্ত পরিচয় বলে মনে করাটা ঠিক নয় বলেই আমি মনে করি ।
ওই শাঁকচুন্নি , রামকৃষ্ণ মিশন ও যত মত তত পথ দিয়ে যে বিষবৃক্ষের বীজ পোঁতা হয়ে গেল , তাকে মহীরূহে পরিণত করতে লেগে পড়লেন একে একে আরও অনেক সাধু সন্ন্যাসী । ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র পূর্ববঙ্গের পাবনাতে তাঁর কেন্দ্র না করে ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে গিয়ে বিরাট আশ্রম স্থাপন করলেন । মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি । তাঁর শিষ্যরা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন , পাবনায় বা বাংলাদেশে ক’জন মুসলমান ঠাকুরের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ? ক’জন দীক্ষা নিয়েছে ? বিরাট ধর্মতত্ত্ববিদ ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ফরিদপুরের মুলকেন্দ্রে ১৯৭১ সালে খানসেনারা হরিনাম করা অবস্থায় আটজন সন্ন্যাসীকে গুলি করে হত্যা করেছিল । সেই আটটা ছােট ছােট সমাধি অমি দেখে এসেছি । সেই ব্রহ্মচারী মহাশয় ফরিদপুর থেকে আমাদের কলকাতার বাগুইহাটিতে পালিয়ে এসে বললেন— ISLAM এর অর্থ I Shall Love All Mankind ! কী বলবেন একে ? ভণ্ডামি , নির্বুদ্ধিতা চরম কাপুরুষতা ? একেই বােধহয় সুগার কোটিং দিয়ে শিবপ্রসাদ রায় বলেছিলেন , “ এঁদের দিব্যজ্ঞান ছিল , কাণ্ডজ্ঞান ছিল না । ‘ সুগার কোটিংটা সরিয়ে নিলে বলতে হয় যে , এঁদের কোন দিব্যজ্ঞানই ছিল না , বরং একটু কাণ্ডজ্ঞান ছিল । তাই তাে পালিয়ে এসেছিলেন । সত্যিই দিব্যজ্ঞান থাকলে ইসলাম , খ্রস্টান ও ইহুদী ধর্মের গোঁড়ামি , Exclusiveness , পরধর্মবিদ্বেষ ও হিংস্রতা বুঝতে পারতেন ।
এরকমই আর একজন গুরু চট্টগ্রামের শ্রীরামঠাকুর । আমাদের এখানে এঁরও বহু শিষ্য । এর বর্তমান যাদবপুরের আশ্রমে রােজ কয়েক মন চালের ভাত হয় । চট্টগ্রামের মুল আশ্রমে হয় মাত্র কয়েক কেজি চালের ভাত । এঁর আশ্রম থেকে দশ টাকা দাম দিয়ে একটা পাঁচালী বই কিনে এনে দেখলাম ইনি নারায়ণের সঙ্গে সঙ্গে হাজী গাজীকেও প্রণাম নিবেদন করছেন । আমার খুবই সন্দেহ হয় যে , ইনি আদৌ গাজী শব্দের অর্থ জানতেন কিনা ! হজ করলে হাজী হয় । কিন্তু গাজী হয় কী করলে ? জানলে কি গাজীকে প্রণাম নিবেদন করতে পারতেন ? আজকাল মুসলমানরা তর্ক করতে গিয়ে বলে , গাজী মানে ধর্মযােদ্ধা । একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা । ইসলামে | ধর্মযােদ্ধাকে বলা হয় জেহাদী , গাজী নয় । ওই ধর্মযুদ্ধ করতে গিয়ে কমপক্ষে একজন অমুসলমানকে হত্যা করলে গাজী উপাধি পাওয়া যায় । ১৪ বছরের বালক বাদশা আকবর যুদ্ধবন্ধী নিরস্ত্র হিমুকে হত্যা করে গাজী উপাধি পেয়েছিলেন । সেই গাজীকে বন্দনা করেন যেসব হিন্দু গুরু তাঁদেরকে কী বলব ?
এইসব ধর্মগুরুদের ছড়ানাে বিকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার বীজই আমাদের হিন্দু সমাজের সর্বনাশ করেছে । একেই আমি বলছি গেরুয়া ধর্মনিরপেক্ষতা বা Saffron Secularism । হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই , একই বৃন্তে দুটি কুসুম , ইত্যাদি কথাগুলাে রাজনৈতিক নেতাদের মুখে শুনে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে না বলেই আমার ধারণা । মানুষ জানে , ভােটের লােভে নেতাদের জিভ থেকে জল পড়ে । তাই নেতাদের মুখে ঐসব কথাগুলাে মানুষ ওইটুকুই মূল্য দেয় । কিন্তু এই গেরুয়াধারীরা । রামকৃষ্ণ মিশনের ওই সন্ন্যাসীরা । তাঁরা যখন রাম-রহিমের ডায়লগ দেন , তখন মানুষ গ্রহণ করে । বীজ পোঁতা হয়ে গেল । অঙ্কুর উদ্গম হল । তারপর সার জল দেওয়ার জন্য আছেন সুনীল গাঙ্গুলী , অমর্ত্য সেন , তপন রায়চৌধুরীরা এবং শাহরুখ , সলমন , আমির , সঈফের খান বাহিনী । এই তিনের ( সন্ন্যাসী , সাহিত্যিক ও বলিউড ) সংমিশ্রণ হল এক Deadly Combination । এই বিষবৃক্ষের বিষাক্ত ফল খেয়ে সমগ্র হিন্দু সমাজ আজ দুর্বল ও বিভ্রান্ত । আর এই ফল খেয়েই সারা ভারতে হিন্দুর ঘর থেকে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা প্রতিবছর চলে যাচ্ছে | মুসলমান ও খ্রীস্টানের ঘরে । এরজন্য আমি সােজাসুজি গেরুয়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দায়ী করছি । তাদের কাছে আমার জোরালাে আবেদন — এবার থামুন । বন্ধ করুন এই মিথ্যাচার । না হলে আমরা বাধ্য হব গেরুয়ার প্রতি হিন্দু সমাজের শ্রদ্ধাকে আঘাত করতে , গেরুয়ার প্রতি সমাজের আস্থাকে কমিয়ে আনতে । কংগ্রেসীদের অবদান যেমন গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ , তেমনি রামকৃষ্ণ মিশনের অবদান গেরুয়া ধর্মনিরপেক্ষতা ।
(নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‛স্বদেশ সংহতি সংবাদ’ পত্রিকায় সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সংখ্যায়)