© অর্ণব কুমার দাস
সন: ২০৪০
গ্রামের নাম গাজীপুর। গ্রাম ছোট, পঞ্চায়েত প্রধান আরও ছোট, তবু দাপটে তাঁর প্রজারা টুঁ শব্দটি করতে পারে না – এমনই প্রতাপ।
দুপুর বেলায় বাড়ি ফিরছিলেন বড় হুজুর।
সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলে পুড়ে ফুটিফাটা হয়ে গেছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়ে পৃথিবীর বুকের রক্ত যেন নিরন্তর ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
এরই সীমানায় পথের ধারে সুনীল হাঁসদার বাড়ি। তার বাড়ির মাটির প্রাচীর পড়ে গিয়ে প্রাঙ্গণ এসে পথে মিশেছে।
পথের ধারে একটা পিটালি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বড় হুজুর উচ্চকণ্ঠে ডাক দিলেন, “ওরে, ও সুনীল, বলি, ঘরে আছিস?”
তার বছর দশেকের মেয়ে সুনীতা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সাড়া দিল, “কেন বাবাকে? বাবার যে জ্বর!”
“জ্বর! ডেকে দে মালুর ব্যাটাকে! ডাক!”
হাঁকডাকে সুনীল হাঁসদা ঘর থেকে বেরিয়ে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়ালো। ভাঙ্গা প্রাচীরের গা ঘেঁসে একটা পুরাতন বাবলা গাছ – তার ডালে বাঁধা একটা গোরু।
ওটাকে দেখিয়ে বললেন, “এই নধর গরুটা কততে বেচবি? আসছে ঈদের জন্য ভালো গরু দরকার।”
সুনীল হাঁসদা ধীরে ধীরে বললো, “না সাহেব, মহেশ আমার পরিবারেরই একজন। বিক্কিরি হবে না।”
হুজুরের চোখ রাগে রক্তবর্ণ হয়ে গেল। দাড়িতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করতে করতে কি যেন বলতে বলতে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন।
সুনীল হাঁসদা স্বস্তি পেলো না। সে জানতো এর পর কী হতে চলেছে…
মহেশের কাছে এসে নীরবে ধীরে ধীরে তার গলায় মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চুপি চুপি বলতে লাগলো, “মহেশ, তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আট সন প্রতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস, তোকে আমি পেটপুরে খেতে দিতে পারি নে – কিন্তু তুই ত জানিস তোকে আমি কত ভালবাসি।”
মহেশ প্রত্যুত্তরে শুধু গলা বাড়িয়ে আরামে চোখ বুজে রইল।
সুনীল চোখের জল গরুটার পিঠের উপর রগড়ে মুছে ফেলে তেমনি অস্ফুটে বলতে লাগলো, “কাজী সাহেব আমাদের মতো মালুদের গ্রামের বাইরে বের করে দিয়েছে, তাতেও শান্তি নেই। এবারের ঈদে তোর দিকে যখন হাজামের নজর পড়েছে তাতে তোকে বাঁচানোর আর কোনো উপায়ই দেখতে পাচ্ছি না রে বাবা। কাজীর শাসনে আমাদের মতো মালুদেরই জীবনের দামই নেই তো আর তোর মতো এক অবলা পশুর জীবন!”
কিছুক্ষণেই কাজীর সদর থেকে তার ডাক পড়লো। সুনীল বুঝলো, এ কথা কর্তার কানে গেছে।
সদরে ভদ্র-অভদ্র অনেকগুলি লোক বসেছিল। কাজীসাহেব চোখ রাঙা করে বললেন, “মালুর ব্যাটা, তোকে যে আমি কি সাজা দেব ভেবে পাই না। কোথায় বাস করে আছিস, জানিস?”
সুনীল হাত জোড় করে বললেন, “জানি। আমরা খেতে পাই নে, নইলে আজ আপনি যা জরিমানা করতেন, আমি না করতাম না। কিন্তু আমার মহেশকে আমি বিক্রয় করব না।”
এই কথা শুনিয়া সভাস্থ সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন এবং এ কাফেরের বাচ্চা যে শুধু কাজী সাহেবের দয়াতেই বেঁচে আছে, সে কথাও জানাতে ভুললো না।
কাজীসাহেবও কাফেরের এই বক্তব্যে খুব রেগে গেলেও প্রকাশ করলেন না। সুনীলকে বিদায় করলেন সেদিনের মতো।…
পরদিন। বিশেষ অনুষ্ঠান। ঈদ। সারারাত গরমে ঘামতে-ঘামতে ও ঘুমাতে পারে নি। সকালের দিকে ঘুম এসেছিল। উঠতে দেরীই হয়ে গিয়েছিল। বিছানা ছেড়ে উঠতে-উঠতে সুনীতাকে হাঁক দিয়ে ডাকলো। উত্তর পেলো না।
একাধিকবার ডাকার পরও সুনীতা সাড়া না দেওয়ায় উঠানে এসে দেখল আগের মতো বাবলা গাছে মহেশও বাঁধা নাই। সুনীতা চরাতে নিয়ে গেছে বোধহয় মহেশকে।
দুপুর হতে চললো। দুজনেরই দেখা নাই। খোঁজ নিতে বেরোলো সুনীল। বেরোতে যেতেই দেখতে পেল দৌড়ে আসছে মিনি। সুনীতার বান্ধবী। এসেই ঘটনাটা বললো কষ্টেসৃষ্টে…..
বাড়িতে এসে দড়িটা নিয়ে বাবলা গাছটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মহেশের রক্তাক্ত শরীরটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার। মিনির সঙ্গে জায়গাটা থেকে ঘুরে এসেছে সে। সুনীতার বিবস্ত্র রক্তাক্ত মৃতদেহের পাশে মহেশও পড়েছিল। অবলা জীবটা মেয়েটাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। পারেনি। মহেশের মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে মেরে থেঁতো করে দিয়েছে ওরা। তারপর ছিঁড়ে খেয়েছে ওরা সুনীতাকে…
বাবলা গাছের উঁচু ডালটায় শক্ত করে দড়িটা বাঁধলো সুনীল। তারপর আকাশের দিকে বিড়বিড় করে কাকে যেন শেষ অভিযোগ জানালো সে…
পাশ থেকে গজলের শব্দ আসছে…ঈদ আজ।