© অরিন্দম পাল
পর্ব-১৫
গভীর ষড়যন্ত্র ও শাহাজী গ্রেপ্তার
শিবাজীর সুভানমঙ্গল দুর্গ অধিকারের খবর যথাসময়ে বাদশাহের কাছে পৌঁছুল। এতটুকু একটা ছেলের এই সব কাণ্ড-কারখানা এবার বাদশাহকে বড়ই বিচলিত করল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলেটি খুব সাধারণ বালক নয় এবং তাকে দমন করা হয়তো খুব সহজ হবে না। তবে একজন সর্দারের সঙ্গে কিছু সৈন্য ও কয়েকখানা কামান পাঠিয়ে তাকে ঠান্ডা করা যেতে পারে। কিন্তু শাহাজী যখন জানতে পারবেন যে তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে বাদশাহ সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়েছেন তখন তিনি নিশ্চয়ই ক্রুদ্ধ হবেন। কর্ণাটকে তাঁর হাতে পনের হাজার সৈন্য আছে এবং তাঁর বিদ্রোহ করার অভ্যাসও বাদশাহের সুবিদিত। তাছাড়া, দক্ষিণের হিন্দু রাজারা শাহাজীকে খুব ভালোবাসে। অতএব তারাও যে তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে না, সে কথা বলা যায় না। শাহাজী বীর ও অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিন বছর ধরে নিজামশাহীকে নিজের কোলের মধ্যে আগলে রেখে ক্রমান্বয়ে দিল্লীর সঙ্গে লড়াই করেছেন। অতএব, শিবাজীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের আগে শাহাজীর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে বাদশাহ আদিলশাহের অত্যন্ত প্রিয় সর্দার আফজাল খাঁ বাদশাহের কাছে একটি পত্র পাঠালেন। তিনি লিখলেন― শাহাজীরাজে ভোঁসলে, বাদশাহের সঙ্গে বেইমানি আরম্ভ করেছে । ভিতরে ভিতরে সে বাদশাহের শত্রুদের মদত জোগাচ্ছে। বাদশাহ যেন এই বিশ্বাসঘাতকের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করেন।
আফজাল খাঁয়ের চিঠি পড়ে বাদশাহ আরো উদ্বিগ্ন হলেন। শিবাজীকে ধরতে গেলে শাহাজী নিশ্চয়ই বিদ্রোহ করবে, এবং শাহাজীকে ধরতে গেলে সে আমার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। তাছাড়া কুতুবশাহ ও মোগলরা তো বিজাপুরের বিরুদ্ধে ওৎ পেতেই আছে । এই সুযোগকে ওরা কাজে লাগাতে ছাড়বে না নিশ্চয়ই। বাদশাহ চিন্তায় পড়লেন ― কী করা যায় ?
বাদশাহ তাঁর মন্ত্রী মোস্তফাখানের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। মোস্তফাখান বাদশাহকে পরামর্শ দিলেন যে, অত্যন্ত গোপনে শাহাজীকে গ্রেফতার করা হোক এবং শিবাজীর বিরুদ্ধেও সৈন্যবাহিনী পাঠানো হোক । এই ষড়যন্ত্রের কথা খুব গোপন রাখা হলো এবং বাদশাহের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ জানতে পারল না।
ওদিকে যখন গোপন ষড়যন্ত্র অনুযায়ী মুস্তাফাখানের ফৌজ এগিয়ে চলেছে, তখন এদিকে শিবাজী ও চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে তার সংকল্প-সিদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্ত শাহাজী বা শিবাজী কেউই জানতেন না তাঁদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর এক সংকট ঘনিয়ে আসতে চলেছে ।
এদিকে শাহাজীরাজার শিবির ছিল জিঞ্জীর কাছেই । মুস্তাফাখানের আগমন বার্তা পেয়ে বাদশাহী রীতি অনুযায়ী শাহাজী তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন। মুস্তাফাখান শাহাজীর শিবিরের কাছেই তার সৈন্যবাহিনীর শিবির স্থাপন করার আদেশ দিল এবং শাহাজীর সঙ্গে অত্যন্ত ভালবাসা ও বন্ধুত্বের অভিনয় শুরু করে দিল। মুস্তাফাখান বুঝতে পেরেছিল যে শাহাজীর সৈনিক ও সর্দাররা তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করে, সুতরাং সহজে শাহাজীকে বন্দী করা যাবে না । অতএব, শাহাজীর আস্থা অর্জনের জন্য প্রতিদিন নতুন-নতুন উপহার নিয়ে তাঁর সঙ্গে একেবারে পরম আত্মীয়ের মত ব্যবহার শুরু করে দিল। কথায় কথায় একদিন শাহাজীকে একথাও বলল, “আমি কোরান এবং আমার পুত্র অতিশ খানের নামে কসম খেয়ে বলছি যে আমার হাত দিয়ে রাজা শাহাজীর কখনো, কোনো ক্ষতি হবে না।।” ক্রমে শাহাজীরাজারও মনে হতে লাগল যে মুস্তফাখানের মতো ভালো মানুষ আর হয় না । এমন সময় একদিন গভীর রাত্রে মুস্তাফাখান অতি গোপনে সব সর্দারদের নিজের তাঁবুতে সমবেত করল। সর্দারদের মধ্যে ছিল আফজল খাঁ, বাজী ঘোরপড়ে, ইয়াকুৎ খান, আজম খান, রাঘো মম্বাজী, বেদাজী ভাস্কর, বালাজী হৈবৎরাও, সিধোজী পাওয়ার, মম্বাজী ভোঁসলে প্রমুখ। মুস্তফাখান তাদের বলল, “আমরা বাদশাহের বিশ্বস্ত সর্দার এবং যে কাজে তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন, প্রাণ দিয়েও আমাদের সে কাজ করতে হবে। এখন শাহাজী ও তার সৈন্যরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাই তারা অচেতন ও অসতর্ক হয়ে আছে। আপনারা সৈনিকদের তৈরি রাখুন এবং শাহাজীর শিবির আক্রমণ করুন। আজ রাতেই শাহাজীকে গ্রেফতার করতে হবে। সকলে যখন ঘুমে অচেতন, সেই সময় মুস্তাফাখান নিজে না গিয়ে, পিছন থেকে আক্রমণ পরিচালনা করতে লাগল। নিশুতি রাতে হঠাৎ চারিদিকে প্রচণ্ড চিৎকার হৈ-হল্লা শুনে শাহাজীর ঘুম ভেঙে গেল এবং শিবির আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ ঢাল-তলোয়ার বর্শা নিয়ে তৈরি হয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু ইতিমধ্যে শাহাজীর অসতর্ক সৈন্যবাহিনীকে একেবারে তছনছ করে শাহাজীর তাঁবুর দিকে ছুটে গেল বাজী ঘোরপড়ে, তার সঙ্গে গেল তার তিন ভাই খন্ডোজী, অম্বাজী ও ভানাজী এবং শাহাজীর আর এক ব্যক্তিগত শত্রু যশোবন্তরাও বাড়বে। খন্ডোজী পাটিল নামে শাহাজীর এক বিশ্বস্ত কর্মচারী প্রভুর বিপদের সংকেত পেয়েই তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে বাজি ঘোরপড়েও তার লোকজনের উপর আক্রমণ করল । একা অনেকক্ষণ লড়াই করে সে এদের আটকে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু অবশেষে বাজীর গদার আঘাতে সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ বীরের মতো মৃত্যু বরণ করল।
শাহাজী রাজাও ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লড়াই করেছিলেন, অকস্মাৎ তাঁর সামনে রক্তের সম্পর্কিত, নিকট-আত্মীয় বাজী ঘোরপড়ে উপস্থিত হল, যার জন্য শাহাজী কত রকম কষ্ট সহ্য করে তাকে উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করলেন। মুস্তাফাখান ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে লাগিয়ে তার ‘কসমের’ মর্যাদা রক্ষা করেছে ! বাজীর সঙ্গে আরও বহু সৈনিক এসে শাহাজীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শাহাজী বীরের মত তাদের আক্রমণ প্রতিহত করলেন এবং কয়েকজন শত্রু-সৈন্যকে নিমেষে খতম করে দিলেন।
কিন্তু একা এতজনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে-করতে হঠাৎ শাহাজী অচৈতন্য হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং বাজী ঘোরপড়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। যিনি একই সঙ্গে সঙ্গে মোগল সম্রাট শাহাজাহান ও বিজাপুরের আদিলশাহকে বছরের পর বছর ধরে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, সেই দুর্ধর্ষ সাহসী বীর শাহাজী আজ বিশ্বাসঘাতকের লৌহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলেন, সেই ভয়ঙ্কর দিনটি ছিল ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে জুলাই ।
(ক্রমশঃ)