© অরিন্দম পাল
পর্ব-১৩
দাদাজী কোন্ডদেবের বিদায়
এদিকে দাদাজী কোণ্ডদেব, এই নতুন ছোট্ট স্বাধীন রাজ্যটিকে সবদিক থেকে সুশৃংখল ও সুসংহত করে তুলতে শিবাজীকে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও পরামর্শ দিয়ে তার মহৎ লক্ষ্য পূরণের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন। কোথায় কী ব্যবস্থা করতে হবে, জায়গা-জমির সঠিক বন্টন ও তার সমুচিত সদ্ব্যবহার, রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্ত কাজ সুপরিকল্পিতভাবে চলছিল । পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলা হল এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হল । শত্রুবেষ্টিত ক্ষুদ্র রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য সুচতুর ব্যক্তিদের নিয়ে গুপ্তচর বাহিনী তৈরি হল । তারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বিদ্যুৎবেগে কাছে পৌঁছে দিতে লাগল ।
দুর্গগুলি এবং অস্ত্রাগার ও কোষাগার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হল । ন্যায়-বিচারের কাজ শুরু হল । দেবস্থান ও ধর্মস্থান তথা মন্দিরগুলি সংস্কার ও নির্ভয়ে সকলের পূজা করার ব্যবস্থা হল । দাদাজী পন্ত শিবাজীকে যেভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, নিজস্ব প্রতিভা, উৎসাহ, দৃঢ় সংকল্প ও দেশাত্মবোধে পরিপূর্ণ শিবাজী যেন তার থেকেও শতগুন শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলেন ।
দাদাজীর শিক্ষা ও জননী জিজাবাঈয়ের সাধনায় সার্থকতা ও সাফল্যের প্রতীক শিবাজীর মধ্যে বাস্তবিক ও বিপুল সম্ভাবনা উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে লাগল।
স্বরাজ্যের সমস্ত কাজকর্ম ক্রমে শিবাজী নিজেই নিজেই করতে আরম্ভ করলেন । বৃদ্ধ দাদাজী পন্ত অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলেন। তাঁর জীবন-সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল । তিনি তাঁর নিজের স্ত্রী-পুত্র পরিবারের জন্য চিন্তিত ছিলেন না, কারণ জিজাবাঈ ও শিবাজী, আপনজনের মতই তাদের দেখবেন তা তিনি জানতেন । তাঁর চিন্তা শুধু শিবাজীর জন্য, আর স্বরাজ্যের এই নূতন চারাগাছটির জন্য । পরম করুণাময় পরমেশ্বরের কাছে তাঁর শুধু এই একটি প্রার্থনা― “স্বাধীনতার এই ক্ষুদ্র দীপশিখাটিকে ঈশ্বর যেন রক্ষা করেন।”
শিবাজীকে ডেকে তিনি বললেন― ‘দেখ রাজা! আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি-বিবেচনায় যেটুকু পেরেছি তোমাকে শেখাবার চেষ্টা করেছি। তুমি যে সেই শিক্ষার চমৎকার আয়ত্ত করেছ তা দেখে আমি খুবই সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হয়েছি । আমার বিশ্বাস, তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দেশের জন্য ও সর্বসাধারন মানুষের জন্য আন্তরিক ভালবাসা এবং নিঃস্বার্থ পরিশ্রম অবশ্যই তোমাকে জয়ী করবে, সর্বতোভাবে সফল করবে । তোমার হাত দিয়ে স্বরাজ ও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে― এটা ঈশ্বরেরই অভিপ্রেত বলে আমি সুনিশ্চিত ।”
শিবাজীর কাছে দাদাজী পন্ত কোণ্ডদেব একধারে গুরু ,শিক্ষক, অভিভাবক ও মন্ত্রী তথা উপদেষ্টা ছিলেন । সেই কারণে শিবাজীর হৃদয়ে দাদাজী স্থান ছিল অতি উচ্চে । তাঁর প্রত্যেকটি শব্দ শিবাজীর কাছে ছিল মন্ত্রের মত । জীবনের শেষ দিনে দাদাজী শিবাজীকে ডাকলেন, ক্ষীণ স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, “শিবাজী রাজা, আমি এত দিন তোমার রাজ্যের সেবক হিসাবে আমার যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছি । তোমার পিতার জমি, জায়গা, প্রজা ও সম্পদের যত্ন করেছি, উন্নত ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি । এখন থেকে তুমি এই সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ কর। স্বাধীনতার যে দীপ তুমি জ্বেলেছ, তার আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিও। আমি বিদায় নিচ্ছি। তোমার জয় হোক।”
একথা বলে দাদাজী কোণ্ডদেব চিরকালের মতো চোখ বুজলেন । (ক্রমশঃ)