© অরিন্দম পাল
পর্ব-৯
প্রথম দুর্গ তোরণা জয়
…এইভাবে পরিভ্রমণ করতে করতে এবং নানা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার পর শিবাজী দেখলেন যে পুনার কাছেই মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে ‘তোরণা’ দূর্গটিই প্রথম অভিযানের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত। দুর্গটির উপর বিজাপুর দরবারের বিশেষ একটা নজর ছিল না । কোথাও, কোনো দিক থেকে হঠাৎ আক্রমণের ভয় বা আশঙ্কা না থাকায় দুর্গটি এক রকম অরক্ষিত অবস্থাতেই ছিল। তবু প্রথম দুর্গ জয়কে একবারে সুনিশ্চিত করার জন্য যে স্বল্প সংখ্যক প্রহরীর দল ছিল তাদের সঙ্গে তাঁর মাবল সর্দারদের দেখা-সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দিলেন। তাঁরা তাদের সঙ্গে দিব্যি বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললেন এবং একে-একে বেশ কয়েকজন প্রহরী শিবাজীর অনুগত ও ভক্ত হয়ে উঠল। দুর্গ-রক্ষকও সাধারণ শ্রেণীর সর্দার ছিল যে, সর্বক্ষণ আরামে ও ভোগ বিলাসিতায় ডুবে থাকত।
শিবাজী একদিন দাদাজী কোণ্ডদেবের সঙ্গে দেখা করে, তাঁর পরিকল্পনার কথা তাঁকে বললেন। শিবাজীর সব কথা শুনে দাদাজী তাঁর এই ষোল বছর বয়স্ক তরুণ শিষ্যের বুদ্ধি, সাহস ও সংকল্প দেখে মুগ্ধ হলেন।
দাদাজী জিজ্ঞেস করলেন ― “কিন্তু সুবেদার কি সহজে দুর্গ ছেড়ে দেবে ?”
শিবাজী বললেন ― “আমি কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীকে সুবেদারের সঙ্গে দেখা করতে পাঠাচ্ছি। ওরা সুবেদারকে বলবে যে, সুলতান তোরণা দুর্গ আমাদের হাতে সঁপে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।”
দাদাজী শিবাজীর এই ছেলে-মানুষী প্রস্তাব শুনে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন। বললেন ― সুবেদার সেকথা শুনবে কেন ? সুলতানের মুদ্রাঙ্কিত সরকারী নির্দেশ ছাড়া সে তার এই আরামের জায়গা কিছুতেই ছেড়ে দেবে না।”
এবার শিবাজী চিন্তায় পড়ে গেলেন। “তাহলে কী করা যায় পন্তজী ?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
“প্রথমে দুর্গের চারিদিকে তোমরা সৈনিকদের শক্ত পাহারা বসাও। যেমন করে পারো দুর্গের সৈনিকদের পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন কর । রাজনীতিতে সাম-দাম-দণ্ড-ভেদ সবগুলি নীতিকেই যেখানে যেমন প্রয়োজন কাজে লাগাতে হবে । তারপর তোমার একান্ত বিশ্বস্ত বলবান্ ও সাহসী সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে অকস্মাৎ সুবেদারকে হত-চকিত করে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে একেবারে ওর সামনে গিয়ে উপস্থিত হও। ওর মুষ্টিমেয় দেহরক্ষীরা কিছু বোঝার আগেই সুবেদারকে বন্দী কর।”
শিবাজী বুঝলেন তিনি ব্যাপারটাকে যত সহজ ভেবেছিলেন, সেটা তত সহজ নয়। দাদাজীর আশীর্বাদ নিয়ে তিনি জননী জিজাবাঈয়ের কাছে গেলেন ― স্বরাজের প্রথম অভিযাত্রায় মার আশীর্বাদ নিতে। মাকে তাঁর সংকল্পের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে জিজাবাঈ পুএকে পরম স্নেহে কাছে টেনে নিলেন― “ওরে আমার শিউবা রাজা, এতদিনে আমার স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। মা ভবানী তোকে অবশ্যই যশস্বী করবেন। তুই জয়ী হবি এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই―” বলতে বলতে জিজাবাঈয়ের কন্ঠে আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল। শিবাজীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেবালয়ে গিয়ে মা ভবানীর পূজা করলেন এবং শিবাজীর মাথায় দেবী চরনের পুষ্প দিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। শিবাজী পরম ভক্তিভরে দেবীকে ও মাকে প্রনাম করে জয়যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন।
দাদাজীর কথামতো দুর্গের বাইরে সর্বত্র তিনি নিজের দুর্ধর্ষ সৈনিকদের মোতায়েন করলেন এবং দুর্গের প্রহরীদের সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করলেন।
দুর্গের মধ্যে প্রবেশের আগে সব ব্যবস্থা পাকা করার পর শিবাজী প্রথমে বাজীরাও পাসলকর, তানাজী মালুসরে ও য়েসাজী কঙ্ককে সুবেদারের সঙ্গে দেখা করতে পাঠালেন এবং তাদের ঠিক পেছনেই ছোট্ট একটি সশস্ত্র দল নিয়ে শিবাজী সেখানে হাজির হলেন। সেই সময় সুরার পাত্র হাতে নিয়ে সুবেদার আয়েশ করে বসে ছিল। হঠাৎ তিন জন শক্ত-সমর্থ সশস্ত্র অচেনা যুবককে একেবারে সামনেই দেখতে পেয়ে ভীষণ রেগে উঠল। “অ্যাই, কে এদের এদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে ? অ্যাঁ ? এই কে আছিস ?”
“আরে এত চেঁচামেচি করছেন কেন সুবেদার সাহেব। আমাদের রাজা শিবাজী আসছেন। এই দুর্গের তিনি মালিক। আপনি তাঁকে দুর্গের অধিকার ছেড়ে দিন,” বাজিরাও বেশ কড়া সুরেই বললেন।
“কে শিবাজী ? কেন ছাড়বো ? অ্যাঁ,এ কী…” বলতে বলতে সুরার পাত্র হাত থেকে পড়ে গেল।
“এই যে আমি শিবাজী !” শিবাজী ঠিক তখনই প্রবেশ করে তলোয়ার বের করে বললেন― “আমরা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়েছি। এই দুর্গ আমাদের।”
হৈ চৈ শুনে সুবেদারের দেহরক্ষীরা ছুটে এল।
তারা বুঝতে পারেনি কখন কোথা থেকে শিবাজী ও তাঁর সশস্ত্র সঙ্গীরা একেবারে সুবেদার সাহেবের খাস কামরায় ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু ওদের তখন খুবই দেরী হয়ে গিয়েছিল। কিছুটা রক্তপাত ঘটলেও, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তোরণা দুর্গ দখল করে নিলেন শিবাজী। তোরণা স্বাধীন হল। ঢাক-ঢোল শিঙা এবং “হর-হর মহাদেব” ও “শিবাজী মহারাজ কী জয়” ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। সাড়ে তিনশো বছর পর সহ্যাদ্রির হৃদয় স্বাধীনতার স্পর্শে স্পন্দিত হয়ে উঠল। সদর দেউড়ির উপর শিবাজী গৈরিক পতাকা তুলে দিলেন।
জননী জিজাবাঈ ও গুরু দাদাজী পন্তও স্বরাজ্যের প্রথম স্বাধীন দুর্গে প্রবেশ করে তোরণাদেবীর মন্দিরে পুজো দিলেন। এই নবলব্ধ স্বাধীনতার ছোঁয়ায় দেবীও প্রাণ ফিরে পেলেন।
তোরণার মেরামতির কাজ আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে মা ভবানীর প্রসাদ লাভ হল প্রসাদ লাভ হল।দুর্গের ভিত পাকা করার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করার সময়ে কয়েকটি বহুমূল্য রত্ন-পরিপূর্ণ কলস উদ্ধার করা হল। চতুর্দিকে আনন্দবার্তা ছড়িয়ে পড়ল এবং সকলে মনে-প্রাণে একথা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করল যে দেবী ভবানী স্বয়ং এই স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই বিপুল অর্থ শিবাজীকে দান করেছেন।
(ক্রমশঃ)