© সূর্যশেখর হালদার
রামায়ণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক আকর বা রত্ন। সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে এই গ্রন্থ। রামায়ণের নায়ক শ্রীরাম। শ্রীরাম মর্যাদা পুরুষোত্তম। তাঁর সমস্ত কার্য সনাতন ধর্ম ও যুগ ধর্মের পক্ষে। তাঁর কার্য আমাদের কাছে শিক্ষামূলকও বটে। তাই রামরাজ্য বলতে আমরা বুঝি এমন এক রাজ্য যা একটি আদর্শ রাজ্য। যেখানে সবাই আধ্যাত্মিক ( শারীরিক ও মানসিক ) সুখ লাভ করে। কিন্তু সেই রামরাজ্যের বিচার ধারা নিয়ে, শ্রীরামের বিচার পদ্ধতি নিয়ে বর্তমানে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এবং কোন একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীরামের চরিত্রকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করে মর্যাদা পুরুষোত্তমকে কলুসিত করার চেষ্টা করছেন। আয়নাতে মুখ দেখার পরিবর্তে তাঁরা আয়না থেকে একটুকরো কাঁচ ভেঙে সেটা দিয়ে সমগ্র মুখমন্ডল অবলোকন করার প্রয়াস করছেন। এইসব সমালোচকগণ যেসব ঘটনার উপর আলোকপাত করেছেন, তারই মধ্যে একটি হল শম্বুক বধ বা শ্রীরাম কর্তৃক শম্বুকের শিরশ্ছেদ।
শম্বুকের উল্লেখ রয়েছে বাল্মিকী রামায়ণের উত্তর কান্ডের ৭২ – ৭৬ সর্গে। একদিন শ্রীরামের দরবারে এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী ব্রাহ্মণ তাঁর মৃত পুত্রকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর পুত্র কৈশোরেই মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে l ব্রাহ্মণ জানালেন যে তিনি কোনদিন মিথ্যা বাক্য বলেননি। হিংসা করেন্ নি বা অন্যকোন পাপও করেন্ নি। কিন্তু তিনি কোন দুষ্কর্ম না করলেও তাঁর পুত্রের অকালমৃত্যু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন যে হয় শ্রীরাম স্বয়ং অথবা নগর বা গ্রামের কোন প্রজা নিশ্চয় কোন দুষ্কর্ম বা পাপ কার্য করেছে, যার ফলে তাঁর পুত্রের অকালমৃত্যু হয়েছে। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে সস্ত্রীক তিনি রাজদ্বারে মৃত্যু বরণ করবেন এবং রাজা অর্থাৎ শ্রীরামের ব্রহ্ম হত্যার পাপ লাগবে।
শ্রীরাম এই শুনে তাঁর ভাইদের নিয়ে আলোচনাতে বসেন। মার্কন্ডেয়, কাশ্যপ, গৌতম, নারদ, বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষি মুনিও সেখানে এলেন। দেবর্ষি নারদ বললেন নিশ্চয় কোন শুদ্র শ্রীরামের রাজত্বে ঘোরতর তপস্যা করছে। কিন্তু ত্রেতাযুগে শুদ্রদের তপস্যা নিয়ম নয়। শুদ্রগণ তপস্যা করতে পারবে কলিযুগে, তাই এই অনাচারের ফলে অকালমৃত্যু হয়েছে।
শ্রীরাম তখন লক্ষণকে ব্রাহ্মণকে আশ্বস্ত করতে বলে আর বালকের দেহ সংরক্ষনের ব্যবস্থা করতে বলে , পুষ্পক রথে আরোহণ করে রাজ্যের সকল দিক পরিদর্শন করতে লাগলেন। তিনি পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বে কোনরূপ দুষ্কৃত দেখতে পেলেন না। অবশেষে দক্ষিণ দিকে গিয়ে দেখলেন শৈবল পর্বতের উত্তরে এক বৃহৎ সরোবর তীরে অধোমুখে লম্বমান হয়ে একজন তপস্বী কঠোর তপস্যা করছেন। শ্রীরাম তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর এই তপস্যার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি তপস্বীকে তাঁর বর্ণ অর্থাৎ তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য না শূদ্র তাও জিজ্ঞাসা করলেন। তপস্বী অধোমস্তকে থেকেই উত্তর দিলেন যে তিনি সশরীরে দেবত্ব লাভের নিমিত্তে তপস্যা করছেন এবং তিনি দেবলোক জয় করতে চান। তিনি আরও জানালেন যে তিনি বর্ণে শূদ্র, নাম শম্বুক, শ্রীরাম তৎক্ষণাৎ খড়্গ কোষমুক্ত করে শম্বুকের শিরশ্ছেদ করলেন। এই ঘটনায় দেবতারা শ্রীরামের প্রতি অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং শ্রীরামের আবেদনে সেই ব্রাহ্মণ পুত্র জীবন ফিরে পেলেন।
এই ঘটনাতে দেখা যাচ্ছে যে এক ব্রাহ্মণ পুত্রকে রক্ষা করার জন্য ব্যক্তিগত শত্রুতা ছাড়াই শ্রীরাম এক শূদ্র তপস্বীকে হত্যা করেছিলেন। বর্তমান যুগে শাসকের এরূপ আচরন নিন্দনীয়, তাই বর্তমান সমালোচকরা এই কার্যের জন্য শ্রীরামের নিন্দা করে থাকেন এবং তাঁকে শূদ্র তথা দলিত বিরোধী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে জান যে বর্তমানকাল কলিযুগ, আর শ্রীরাম এই কার্য করেছিলেন ত্রেতা যুগে। যুগের নিয়মই ছিল যে , কোন শূদ্র তপস্বা করতে পারবে না। তাই শ্রীরাম এই তপস্বীকে হত্যা করে যুগোপযোগী কাজ করেন। তাহলে প্রশ্ন উঠবে শ্রীরাম কি যুগোত্তীর্ণ নন? তাঁকে কলিযুগে আমরা আদর্শ হিসাবে মানব কেন? এর উত্তরে বলা যায় যে তিনি এমন একজন শাসক যিনি যুগের নিয়ম অনুযায়ী দেশ শাসন করেন। আজকের যে শাসক শ্রীরামকে দেখে শিক্ষা নেবেন, তিনি ত্রেতা যুগের নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র শাসন করবেন না, বরং কলিযুগের নিয়ম বা রাষ্ট্রীয় সংবিধান মেনেই রাষ্ট্র শাসন করবেন।
এরপরে যে প্রসঙ্গ আসে তা হল শ্রীরামের শূদ্র বিরোধী বা দলিত বিরোধী আচরণ। তিনি দলিতকে মেরে ব্রাহ্মণকে বাঁচান। দলিত স্টাডিজ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা এটাকে কাজে লাগান দলিতদের শ্রীরামের বিরুদ্ধে এককাট্টা করতে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আদৌ এই অভিযোগ সত্য কি? প্রথমত: শম্বুক হত্যার পরেও অন্যান্য যেসব শূদ্র রাজ্যে ছিলেন তাঁরা শ্রীরামের বিরুদ্ধে কোন গণবিদ্রোহ করেন নি। তৎকালীন সময়ের ঋষিগণ, যাঁদেরকে আজকের সমাজে বুদ্ধিজীবি বলে তাঁরাও কিন্তু শ্রীরামের এই পদক্ষেপ সমর্থন করেন। ব্রহ্মর্ষি অগস্ত্য, যিনি ঋগ্বেদের ভাষ্য রচনা এমনকী তামিল ভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন তিনিও শ্রীরামের এই বিচার সমর্থন করেন।
রামায়ণে শম্বুকই কিন্তু একমাত্র দলিত বা শূদ্র নয়। শ্রীরাম এর সঙ্গে বহু দলিতেরই সাক্ষাৎ এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখ্য নিষাদরাজ গুহ যিনি শ্রীরামের পরম মিত্র ছিলেন। বনবাসে যাবার সময় তাঁর রাজ্যে শ্রীরাম এক রাত কাটান। আবার ফেরার সময়ও তাঁর সঙ্গে শ্রীরামের সাক্ষাৎকার ঘটে এবং পরস্পর ভাব বিনিময় হয়।শ্রীরামের রাজ্যাভিষেকের সময় ও নিমন্ত্রিত ছিলেন এই নিষাদ রাজ l
অরণ্যকান্ডের একে বারে শেষে আমরা আরেক শূদ্র নারীকে দেখতে পাই যাঁর নাম শবরী। শবরী ছিলেন মতঙ্গ মুনির আশ্রমের পরিচারিকা। তিনি নিম্নবর্গীয়, শবর কিন্তু তাঁর ভক্তিই তাঁকে শ্রীরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটায়। গোস্বামী তুলসীদাসজী রামচরিত মানস গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন শবরীর রামভক্তির কথা। শ্রীরাম শবরীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। শবরীর সংগ্রহ করা বুনোফল শবরীর পর্ণকুটীরে বসে গ্রহন করেন এবং তাঁর সাধনা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন ( অরণ্যকান্ড সর্গ ৭৪ – ৭৫ )। মাতা শবরী শ্রীরামের সামনেই অগ্নিতে আহুতী দিয়ে স্বর্গধামে যাত্রা করেন। এটাই ছিল তাঁর ইষ্টলাভ।
এঁরা ছাড়াও বানর, ভাল্লুক, পক্ষী অর্থাৎ মনুষ্যতর জীবও শ্রীরামের প্রিয়ভাজন হন। রঘুবীর হনুমানের মত বানরকে ভরতের সমান প্রিয় ভাই, সংকটমোচন ইত্যাদি সম্ভাষণে ভূষিত করেন। সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনুমান সহ বানররা, জাম্ববান ( ভল্লুকদের রাজা ) শ্রীরামের রাজ্যাভিষেকের সময় সম্মানিত অতিথির আসন অলংকৃত করেন। বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডে [ সর্গ ১২৭ – ১২৮] বর্ণিত রয়েছে শ্রীরামের রাজ্যাভিষেকের জন্য পবিত্র জল নিয়ে আসেন হনুমান, জাম্ববান ও ঋষভ। এনারা হয় বানর নয় ভল্লুক। সিংহাসন লাভের পর শ্রীরাম সুগ্রীবকে মনিময় কাঞ্চনহার আর অঙ্গদকে বৈদূর্যভূষিত অঙ্গদ উপহার দেন। সীতা শ্রীরাম প্রদত্ত উজ্জ্বল মুক্তাহার হনুমানকে প্রদান করেন। অন্যান্য বানর ও রাক্ষসরাজ বিভীষণও যথাযথ উপহার পান। আবার পক্ষীরাজ জটায়ুর শেষকৃত্য করে শ্রীরাম মনুষ্যতর মিত্রদের প্রতি তাঁর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। পরিশেষে একথা বলা যায় শ্রীরামের সবচেয়ে বড় ভক্ত হনুমান কিন্তু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় নয়, বরং বানর জাতির। তাই শ্রীরাম যে নীচ জাতিকে সম্মান দিতেন না, একথা ভাবলে ভুল হবে। তিনি এমন এক সংস্কৃতির ধারক ছিলেন যেখানে মানুষ ও অন্যান্য জীবের মধ্যেও মেলবন্ধন ঘটেছিল।
শম্বুক হত্যার কারণ হিসাবে যদিও তৎকালীন যুগের বিধিভঙ্গের কথাই আমরা বাল্মিকী রামায়ণে পেয়ে থাকি, তবুও শ্রীরাম এবং শম্বুকের কথোপকথন কিন্তু শম্বুকের চরিত্রের একটি বাজে দিককে সামনে নিয়ে আসে, সেটি হল শম্বুকের উচ্চাকাঙ্খা। শম্বুক শুধু সশরীরে স্বর্গলোক পৌঁছতে চেয়েছিলেন তাই না, তিনি দেবলোক জয় করার ইচ্ছা শ্রীরামের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। এরূপ দেবলোক জয় করার ইচ্ছা আমরা দেখি অসুরগণ যেমন রাবণ, ইন্দ্রজিৎ বা কুম্ভকর্ণের মধ্যে। কুম্ভকর্ণের তপস্যার উদ্দেশ্য ছিল ইন্দ্রাসন। ভুল করে তিনি ব্রহ্মার কাছে নিদ্রাসন চেয়ে বসেন ( সে সময় দেবী সরস্বতী তাঁর জিহ্বায় অবস্থান করেন )। রাবণ তো দেবলোক আক্রমণই করেন আর ইন্দ্রজিৎ তাঁর নাম প্রাপ্ত হন ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করে। তাই দেখা যাচ্ছে যে দেবলোক জয় করার আসুরিক ইচ্ছা শম্বুকের মধ্যে ছিল। কুম্ভকর্ণও একই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রহ্মার তপস্যা করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের পরামর্শে দেবী সরস্বতী স্বয়ং কুম্ভকর্ণের এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে দেন নি। শ্রীরামের আচরণও শম্বুকের এই উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হতে দেয় না।
পরিশেষে একথা বলতে হয় যে উত্তর কান্ডতে শম্বুকের শিরশ্ছেদ বর্ণিত হয়েছে, তা সম্ভবতঃ রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ। আমাদের মনে রাখতে হবে ভারত ভূমিতে রামায়ণ এর লেখক অনেক। একথা ঠিক যে বাল্মিকী সংস্কৃত ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচনা করেন, কিন্তু তারপর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এবং সংস্কৃততেও অনেকে রামায়ণ লিখেছেন। এই রামায়ণ গুলি বাল্মকী রামায়ণের সঙ্গে পুরোপুরি এক নয়; বর্ণনাতে, চরিত্র চিত্রণে তফাৎ আছে। তাই শম্বুকের ঘটনা বাল্মিকী লিখেছেন, না অন্য কেউ তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে যেভাবেই এই ঘটনা মূল রামায়ণে যুক্ত হোক না কেন সেটা শ্রীরামকে কলুষিত করার জন্য হয় নি। রামায়ণকে বর্তমাণ দলিত স্টাডিজের চোখ দিয়ে দেখলে বা বিচার করলে এবং এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীরামকে দলিত বিরোধী প্রমাণ করলে তা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের সামিল হবে।