© অরিন্দম পাল
পর্ব-৫
বালক শিবাজী ও দাদাজী কোণ্ডদেব
…. কর্তব্য-নৈপুণ্য, সু-ব্যবস্থা, শৃঙ্খলা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য দাদাজী কোণ্ডদেব সর্বত্র সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর কর্তব্য-কঠোরতা সম্বন্ধে মহারাষ্ট্রে এক কথা প্রচলিত আছে। একবার তার জনৈক এক কর্মচারী শাহবাগ থেকে কিছু ফল নিয়ে এল। একটা ফল কাটা হল। তিনি সে সুস্বাদু ফলের টুকরো মুখে তুলতে যাবেন তখনই তাঁর মনে একটা খটকা লাগল। জিজ্ঞেস করলেন – “এই ফলটা কোথা থেকে এনেছ ?” কর্মচারী বলল শাহবাগ থেকে। দাদাজী বললে উঠলেন ― “ওহ! তাহলে তো আমার হাত দিয়ে বিরাট অপরাধ হয়ে গেছে, পরের জিনিস চুরির অপরাধ।” পুরানো কর্মচারী বলল ― “আপনি এ কথা কেন বলছেন ? আপনিই তো এই জাগীরের সব কিছুর মালিক।”
দাদাজী বললেন― “না, সে কথা ঠিক নয়। আমি মালিক নই। আমি এই জাগীরকে রক্ষা করার জন্য এবং এর উন্নতি করার জন্য নিযুক্ত সেবক মাত্র। প্রভুর অগোচরে তাঁর কোন জিনিস ভোগ করার অধিকার আমার নেই।
তখন একজন বলল ― “এ রকম তো সকলেই করে। তাছাড়া, দু-একটা ফল পেড়ে খাওয়াটা এমন কিছু মারাত্মক ব্যাপার নয়।”
দাদাজী বললেন ― আমি অন্য সকলের মত হতে চাইনা। বিনা অনুমতিতে অপরের জিনিস নেওয়া চুরি ছাড়া কিছুই নয়। সে জিনিস ছোট হোক বা বড় তাতে কিছু তফাৎ হয়না। আমি চুরি দোষে দোষী। এর দণ্ড আমাকে পেতেই হবে।”
পুরনো কর্মচারীটি বলল ― “এটা আমার হাত দিয়ে হয়েছে হয়েছে, দণ্ড আপনি কেন ভোগ করবেন ? আপনি আমাদের শাস্তি দিন।”
দাদাজি উত্তর দিলেন ― “কর্মচারী দোষ করলে উপরওয়ালার উপরেই তার দায়িত্ব বর্তায়। ন্যায়শাস্ত্র এই কথা বলে। যাও, তলোয়ার নিয়ে এসো। প্রভুর বাগানের ফল আমি ডান হাত দিয়ে খেতে উদ্যত হয়েছিলাম। আমার এই হাত কেটে ফেল।”
দাদাজীর এ কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল। বয়স্ক ব্যক্তিরা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। সে কর্মচারীটি বাগান থেকে ফল পেড়ে এনেছিল সে কাঁদতে শুরু করল। তারপর সে ছুটে গিয়ে জিজাবাঈকে সব ঘটনার কথা বলল। জিজাবাঈ শিবাজীকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দাদাজীর কাছে এসে তাঁকে ঐ মারাত্মক দণ্ড গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত করলেন।
কথিত আছে সেই দিন থেকে দাদাজী একটা হাত-কাটা জামা পড়তেন এবং এইভাবে সবসময়ে নিজের একনিষ্ঠ সেবাব্রত ও কর্তব্য পরায়নতার কথা মনে রাখতেন। তাঁর সততার প্রভাবে অধস্তন কর্মচারী বা সর্দার কখনো কোনো দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা বা অন্যায়ের পথে যাবার সাহস পেতনা। দাদাজীর নামের উল্লেখ মাত্রই সুশৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ হত।
দাদাজী কোণ্ডদেব কাছে শিবাজী লেখাপড়া, অস্ত্রবিদ্যা, রাজনীতি ও সমর শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ জীবনের ব্যবহারিক ও নৈতিক শিক্ষার ও পাঠ নিতেন। শাসন কার্যের ছোট-বড় সব ব্যাপারেই দাদাজী, শিবাজীকে তাঁর কাছে রাখতেন, সর্বত্র সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোথায় নূতন কী কাজ করতে হবে, তার পরিকল্পনা রচনা করা, কোথাও কোনো অন্যায় ঘটে থাকলে ন্যায় বিচার করা – সব শিবাজীর উপস্থিতিতেই চলত। শিবাজী সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে সব দিকে নজর রাখতেন এবং কোন কাজ কিভাবে করা উচিত করা উচিত সে বিষয়ে তাঁর অনন্য বুদ্ধি ও মেধার সাহায্য পরিস্কার ভাবে বুঝে নিতেন।
দাদাজী এর পর শিবাজীকে সঙ্গে নিয়ে জাগীরের অন্তর্গত প্রত্যেকটি গ্রামে একে একে পরিদর্শন শুরু করলেন। এই জন-সম্পর্কের সময়ে গ্রামের প্রধান ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমবেত করা হত। শিবাজী কে উঁচু আসনে বসিয়ে সভার কাজ শুরু হত। গ্রামে কোথায় কী অসুবিধা, আর কী অভিযোগ শোনা হতো। কোন বিবাদ-বিসংবাদ থাকলে সামনেই তার মীমাংসা করা হত।
গ্রামবাসীরাও উপলব্ধি করত যে রাজা তাদের সব রকম নিরাপত্তা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে তৎপর।
গ্রামের মানুষদের সঙ্গে শিবাজী অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন। তাদের মধ্যে কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও বুদ্ধিমান যুবকদের সঙ্গে শিবাজী বন্ধুর মতো ভাব জমিয়ে নিতেন।
এইভাবে গ্রামে গ্রামে তার ঘনিষ্ঠ ও একান্ত অনুগত বন্ধুর সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি শিবাজী কে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে লাগল। তারা শিবাজীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে লাগল, তাঁর নির্দেশে সবকিছু করার জন্য তারা সর্বক্ষণ প্রস্তুত। এভাবে গ্রামে-গ্রামে এইসব বন্ধুর দল এক তেজস্বী, নির্ভীক, সুশৃঙ্খল, কর্তব্যনিষ্ঠ সংগঠনের রূপ গ্রহণ করল। এইসব তরুণরা ছিল পুনা এবং সংলগ্ন সহ্যাদ্রি পর্বত অঞ্চল বনাঞ্চলের প্রকৃত প্রাণ-সম্পদ। তাদের মাধ্যমে পুনার সীমিত অঞ্চল ছাড়িয়ে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত শিবাজীর অনুপ্রেরণায় এক নূতন রক্তের, নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি হতে লাগল। সর্বত্র দেশাত্মবোধ, পারস্পরিক ঐক্য, সাহস, পরাক্রম ও স্বাভিমানে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠতে লাগল সেই সব মানুষ যারা এযাবৎ ছিল ম্রিয়মান, হতাশ, হতচেতন ও নিদ্রিত ।
(ক্রমশঃ)