
© সূর্য শেখর হালদার
রামায়ণ শব্দের অর্থ হল রামের অয়ন বা যাত্রা। এই আদি কাব্য শ্রীরামের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমগ্র জীবনের বর্ণনা দেয়। বাল্মীকি রামায়ণ অনুসরণ করলে আমরা দেখব শ্রীরামের ধরাধামে আর্বিভাব এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যেটা হল রাবণ বধ। বালকান্ডের সর্গ ১৪-১৭ তে আমরা দেখি দেবতারা রাবণের পীড়নে অস্থির হয়ে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে আবেদন করছেন রাবণ যাতে বিনষ্ট হয় সেই ব্যবস্থা নিতে। তখন সেখানে উপস্থিত হন শঙ্খ-চক্র-গদাপানি ভগবান বিষ্ণু। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের অনুরোধে নরজন্ম গ্রহন করে দশরথের পুত্র হয়ে জন্ম গ্রহণ করতে রাজি হলেন। (১) উদ্দেশ্য রাবণ ধ্বংস, সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে রাবণ বা দশানন হলেন স্বয়ং বিষ্ণুর প্রতিদ্বন্দ্বী , অন্যান্য দেবতারাও রাবণ বধের জন্য বানর রুপে জন্মগ্রহণ করেন। সূর্য উৎপন্ন করেন সুগ্রীবকে, পবনদেব হনুমানকে, কুবের গন্ধমাদনকে, বরুন সুষেনকে, বিশ্বকর্মা নলকে, অগ্নিদেব নীলকে, অশ্বিনীকুমার দ্বয় মৈন্দ ও দ্বিবিদকে। (২) এছাড়াও ভগবানের অবতারকে সাহায্য করার জন্য আগেই স্বয়ং ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন ঋক্ষরাজ জাম্ববানকে। (৩) তাই রাবণ অতি গুরুত্বপূর্ন চরিত্র, তাঁর চরিত্র বিচারও খুব গুরুত্ব সহকারে করা উচিত।
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড : সর্গ নং : শ্লোক নং
১.বালকান্ড :১৬ :৮ l
২. বালকান্ড :১৭: ৯,১১,১২,১৩,১৪,১৫
৩. বালকান্ড : ১৭ : ৬
💐💐💐
রাবনের জন্ম:
রাবণ এবং তাঁর ভাই বোনদের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কান্ডে ( সর্গ ৯-১৩)। মহামুনি অগস্ত্য শ্রীরামকে রাবণাদির জন্মবৃত্তান্ত বর্ননা করেন। রাবণ ছিলেন রাক্ষস জাতির অন্তর্ভুক্ত। রাক্ষস শব্দটি এসেছে ‘রক্ষাম:’ শব্দ থেকে। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথমে জল সৃষ্টি করেন। তারপর
প্রাণীগনকে সৃষ্টি করে বলেন ‘তোমরা সযত্নে এই জল রক্ষা কর’, তখন একদল প্রাণী বলে ‘রক্ষাম:’ অর্থাৎ ‘আমরা রক্ষা করব’, ব্রহ্মার আদেশে এরাই হল রাক্ষস। আর একদল প্রাণী বলে- ‘যক্ষাম:’ অর্থাৎ ‘আমরা পূজা করব’। এরা হল যক্ষ।
এই রাক্ষস বংশেই জন্ম হয় সুকেশের। এই সুকেশ আর গন্ধর্ব কন্যা দেববতীর তিন পুত্র হল – মাল্যবান, সুমালী আর মালী। তাঁরা ছিলেন তেজস্বী ও উগ্রস্বভাব। সুমেরু পর্বতে তপস্যা করে তাঁরা ব্রহ্মার থেকে অজেয় শত্রুহন্তা, চিরজীবি ও প্রভুত্বশালী হবার বর পান। তাঁদেরই অনুরোধে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ত্রিকূট পাহাড়ের উপর লঙ্কাপুরী নির্মান করলেন। এই সকল রাক্ষসদের উৎপীড়নে দেব ও ঋষিগন আর্ত হলে মহাদেবের কাছে গেলেন। কিন্তু যেহেতু এঁরা মহাদেবের অবধ্য, তাই তাঁরা মহাদেবের নির্দেশে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ভগবান বিষ্ণু তাঁদের আশ্বস্ত করলেন এবং এরপরেই মদমত্ত রাক্ষসকুল দেবগণ কে আক্রমণ করলেন। কিন্তু যুদ্ধে ভগবান বিষ্ণুর সেনারা রাক্ষস সৈন্যদের পরাভূত করল। মালী নিহত হলেন। সুমালী ও মাল্যবান লঙ্কা ত্যাগ করে সপত্নীক পাতালে আশ্রয় নিলেন। রাক্ষসরা পাতালে আশ্রয় নিলে ধনেশ্বর কুবের (যক্ষ) লঙ্কা অধিকার করলেন।
এর কিছুকাল পরে সুমালী তাঁর কন্যা কৈকেসী (নিকষা) কে নির্দেশ দিলেন পুলস্ত্য মুনির পুত্র বিশ্রবাকে পতিত্বে বরণ করতে। অভিপ্রায় ছিল কৈকেসীর গর্ভে এক তেজস্বী পুত্র উৎপাদন, (৪) কিন্তু কৈকেসী গুনবাণ বিশ্রবার কাছে এলেন প্রদোষকালে। কৈকেসী পুত্রলাভের ইচ্ছা ব্যক্ত না করলেও মুনি তপোবলে তা জেনে যান এবং বলেন, ‘তোমার বাসনা পূর্ণ হবে, কিন্তু এই দারুন সন্ধ্যায় পুত্র কামনার জন্য তুমি ক্রূরকর্মা রাক্ষস প্রসব করবে’। কিন্তু কৈকেসী সুপুত্র চান, তাই মুনি বললেন কৈকেসীর কনিষ্ঠ পুত্র হবে ধর্মাত্মা। (৫) যথাকালে কৈকেসীর তিন পুত্র ও এক কন্যা জন্মলাভ করলেন, জ্যেষ্ঠ হল দশগ্রীব যে পরবর্তীকালে হবে রাবণ (দশ মাথা হবার কারনেই পিতা দশগ্রীব নাম দেন)। মধ্যম কুম্ভকর্ণ আর কনিষ্ঠ ধর্ম ও শাস্ত্রজ্ঞানী বিভীষণ, রাবণের জন্মের সময় প্রকৃতির মধ্যে নানা অশুভ লক্ষন দেখা যায়।
(৬) রাবণের জন্মের ইতিবৃত্ত লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তিনি ব্রাহ্মন ও রাক্ষসের মিশ্রন, পুরো রাক্ষস তিনি নন। তাঁর বংশে ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে বৈরিতা আগে থেকেই ছিল। আর রাবণ যে ক্রূর স্বভাবের হবেন তা তাঁর পিতা আগে থেকেই উপলব্ধি করেন কারন কৈকেসী তাঁর কাছে আসেন কামার্ত মত্ত হস্তিনীর মত। (৭)
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড :সর্গ নং :শ্লোক নং
৪. উত্তরকান্ড ৯: ১১
৫. উত্তরকান্ড: ৯ :২৬
৬. উত্তরকান্ড: ৯: ২৬ – ৩১
৭. উত্তরকান্ড: ৯ :২২ – ২৪
💐💐💐
রাবণের তপস্যা ও যুদ্ধজয়:
রাবণের মাতা চেয়েছিলেন যে রাবণ হোক তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই কুবেরের মত। রাবণ কিন্তু কুবেরকে ঈর্ষা করতেন। তাই তিনি তাঁর ভাইদের নিয়ে তপস্যা শুরু করেন। ব্রহ্মার থেকে তিনি বরও আদায় করেন এবং তার ফলে রাবণ পক্ষী, নাগ, যক্ষ, দৈত্য, দানব, রাক্ষস ও দেবগণের অবধ্য হন। এখানে উল্লেখ্য যে এই বর চাওয়ার সময় রাবণ নর, বানর ও অন্যান্য পশুদের কথা উল্লেখ করেন নি কারন তিনি অন্য প্রানীদের তৃনের মত তুচ্ছ মনে করতেন। তাঁর এই অবজ্ঞা তাঁর দাম্ভিকতার প্রকাশ। সেকারনেই ভগবান বিষ্ণু ও অন্যান্য দেবগণ নর ও বানর রূপে জন্মগ্রহন করেন রাবণবধের উদ্দেশ্যে। রাবণ ব্রহ্মার নিকট আরও একটি বর পান, সেটি হল – ‘রূপঞ্চ মনসা যদ যথেপ্সিতম্’। (৮) সীতাহরণের সময় এই বরের সাহায্যেই তিনি প্রথমে স্বাভাবিক রূপ আর তারপর ভীষন রূপ ধারণ করেন। (৯)
তিন দৌহিত্র বর পেয়েছে শুনে সুমালী আবার লঙ্কা জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকলেন। দশানন প্রথমে কুবেরের বিরোধীতা করতে চান নি, কিন্তু মাতুল প্রহস্তের (১০) পরামর্শে তিনি কুবের কে লঙ্কা ত্যাগ করতে বলেন। পিতা বিশ্রবার পরামর্শে কুবের লঙ্কা ত্যাগ করে সপরিবার কৈলাস চলে গেলেন।
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড : সর্গ নং :শ্লোক নং
৮. উত্তরকান্ড :১০ :২৪
৯. অরন্যকান্ড :৪৯ :৬ – ৯
১০. এই প্রহস্ত সুমালীর ছেলে। রাবণ ও মন্দোদরীর আরেক পুত্রের নাম ছিল প্রহস্ত।
কুবের চলে গেলে লঙ্কার রাজা হলেন রাবণ। রাজ্যলাভের পর তিনি দানব রাজ ময়ের কন্যা এবং অপ্সরা হেমার গর্ভজাত মন্দোদরীকে বিবাহ করেন, ভাই বোনদেরও বিবাহ দেন।
কিছু সময়ের মধ্যে রাবণ হয়ে উঠলেন অত্যাচারী। বড় ভাই কুবের দূত মারফত রাবণকে ধার্মিক ও সদাচারী হবার পরামর্শ পাঠালেন। এতে রাবণ রেগে গিয়ে খড়্গের আঘাতে দূতকে বধ করে তাকে ভক্ষনের জন্য রাক্ষসদের দিলেন। এরপর রাবণ কৈলাসে কুবেরকে আক্রমন করতে গেলেন এবং কুবেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে পুষ্পক বিমান ( যা ব্রহ্মা কুবেরকে দেন ) দখল করলেন।
কুবেরকে পরাস্ত করে রাবণ ভগবান শিবশংকরের কাছে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল কৈলাশ পর্বত ভুজবলে ওঠানো। পর্বতবাসীগণ ও পার্বতী স্বয়ং এতে চঞ্চল হলে মহাদেব পায়ের আঙ্গুল দিয়ে পর্বতকে চেপে দিলেন এবং তার ফলে রাবণের শিলাস্তম্ভ তুল্য বাহু পর্বতের তলায় চাপা পড়ল। তিনি ত্রিলোক কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠলেন। অমাত্যদের নির্দেশে তিনি মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন। মহাদেব তখন সন্তুষ্ট হয়ে রাবণের হাত মুক্ত করলেন আর বললেন দশানন যেহেতু নিপীড়িত হয়ে ভয়ানক রব করেছিলেন, তাই তাঁর নাম হবে রাবণ। এছাড়াও তিনি চন্দ্রহাস নামক মহাদীপ্ত খড়্গ রাবণকে দিলেন।
বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কান্ডের ১৪ – ১৬ সর্গে এইসব ঘটনা বর্নিত হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে রাবণ মহাদেবের ভক্ত হন, তাঁর কাছে পরাজিত হয়ে। প্রথমে মহাদেবের প্রতি তাঁর তেমন বিশেষ কোন ভক্তি ছিল না। কারন কুবেরের দূত উল্লেখ করেন যে কুবের শংকরের বন্ধু, কিন্তু তখন রাবণ সেই বার্তাকে পাত্তা দেন নি। এছাড়াও দূত হত্যার মত নির্মম এবং রাজধর্ম বিরোধী কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। ধর্মের পথে চলার পরামর্শ তিনি পছন্দ করতেন না। পরবর্তীকালে এই কারনেই ধর্মাত্মা, শাস্ত্রজ্ঞানী কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিভীষণকে তিনি রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন।
বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকান্ডের ১৭ থেকে ২৩ সর্গে রাবণের আরও বিজয়গাথা বর্নিত হয়েছে। মহবলে বলীয়ান রাবণ যম, সূর্য, বরুণ প্রভৃতি দেবগণ কে, নাগগণ কে, কালকেয় নামে দৈত্যগণকে, এবং দুষ্কন্ত, সুরথ, গাধি, গয়, পুরুরবা, অনরণ্য ( শ্রীরামের পূর্বপুরুষ ) প্রভৃতি বহু ক্ষত্রিয়রাজাকে পরাভূত করেন। একমাত্র হৈহয় প্রদেশের ( জব্বলপুরের কাছে ) রাজা কার্তবীর্যার্জুন আর বানর রাজ বালী রাবণকে পরাজিত করেছিলেন। এর থেকে প্রমান হয় রাবণ ছিলেন অমিত পরাক্রমশালী বীর যোদ্ধা। তিনি বেদজ্ঞ পন্ডিতও ছিলেন। বিভীষণ তাঁকে, ‘বেদান্তবিদ, অগ্নিহোত্রী, মহাতপস্বী, যাগযজ্ঞে পারদর্শী’ বলে বর্ণনা করেছেন। (১১) হনুমান যখন লঙ্কা যান তিনিও বলেন,
“অহো রূপমহো, ধৈর্যমহো সত্ত্বমহো দ্যূতি অহো রাক্ষসরাজস্য
সর্বলক্ষণ যুক্ততা”। (১২)
( কি আশ্চর্য মহৎরূপ, মহৎ ধৈর্য, মহৎ পরাক্রম, সর্বলক্ষণ যুক্ত, কি আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের প্রভা। )
তবে বিদ্বান, বুদ্ধিমান হনুমান কিন্তু রাবণের দুর্বলতা – তাঁর দম্ভ আর অপরিমিত কামের কথাও উল্লেখ করেন। শ্রীরামও প্রথম দর্শনে রাবণের রূপ ও তেজের প্রশংসা করেন। (১৩)হনুমানের মতে রাবণের অহংকার আর অপরিমিত কাম না থাকলে তিনি স্বর্গের রাজা হতেন। (১৪) পিতা বিশ্রবাও রাবণের ঔদ্ধত্যকে তাঁর পতনের কারন হবে বলে পূর্বাভাস করেন। (১৫)
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড : সর্গ নং :শ্লোক নং
১১. যুদ্ধকান্ড :১০৯ :২৩
১২. সুন্দরকান্ড :৪৯ :১৭
১৩. যুদ্ধকান্ড : ৫৯ :২৭ – ২৮
১৪. সুন্দরকান্ড : ৯ :১৮
১৫. উত্তরকান্ড: ১১:৩৬ – ৪০
💐💐💐
রাবন ও নারীলোলুপতা:
রাবণ চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক হল তাঁর নারীলোলুপতা যা তার পতনের কারন হয়। সীতাহরণের বহু পূর্বেই রাবণ নারী নিগ্রহ ও ধর্ষনের পাপে কলুসিত হন। তিনি বেপরোয়াভাবে ঋষিকন্যা ও দেবকন্যাদের অপহরণ করতেন। এরকমই এক ঋষিকন্যা বেদবতী ( মহর্ষি কুশধ্বজের কন্যা ) পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী তপস্যা করছিলেন ভগবান বিষ্ণুকে স্বামীরূপে পাবার জন্য। রাবণ তাঁকে পত্নী হবার জন্য আহ্বান জানান। বেদবতী তা প্রত্যাখ্যান করলে রাবণ তাঁর কেশ স্পর্শ করেন ( উত্তর কান্ড, সর্গ ১৭ )। বেদবতী রাবণের দ্বারা নিগ্রীহিতা হয়ে অগ্নিকুন্ডে প্রাণ দেন এবং বলেন তিনি কোন ধার্মিকের অযোনিজা কন্যারূপে পুনর্বার জন্মগ্রহন করবেন এবং রাবণের মৃত্যুর কারন হবেন। মুনি অগস্ত্যর বর্ননা অনুযায়ী বেদবতীই সীতা হয়ে জন্মগ্রহন করেন।
আর এক অপ্সরা যাঁকে রাবণ ধর্ষন করেন। তিনি হলেন রম্ভা। রম্ভা যখন কুবের পুত্র নলকুবেরের সঙ্গে সাক্ষাতে চলেছেন তখন রাবণ তাঁকে আটকান, রাবণের কামনাসিদ্ধ করার জন্য। রম্ভা রাবণের নিকট অনুনয় করে বলেন যেহেতু তিনি নলকুবেরের প্রেয়সী, সেহেতু রাবণ তাঁর গুরুজন। কিন্তু রাবণ তাঁকে বলপূর্বক ধর্ষন করেন এই যুক্তিতে যে অপ্সরাদের কোন পতি হয় না, তারা একপতির প্রতি একনিষ্ঠ থাকে না ( উত্তরকান্ড, সর্গ ২৬ )।
নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য না দেওয়া এবং নারীকে ভোগ্য বস্তু মনে করাই রাবণের কাল হয়। কারন একইভাবে বলপূর্বক তিনি শ্রীরাম ও লক্ষণের অনুপস্থিতিতে ছলনা ও চাতুরীর সাহায্যে সীতাহরণ করেন। সীতার রূপের বর্ণনা তিনি শোনেন বোন শূর্পনখা আর জনস্থান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা সেনাপতি অকম্পনের নিকট। দুজনেই রাবণের কামুক স্বভাবের কথা জানতেন। তাই তাঁরা রাবণকে প্রলুব্ধ করার জন্যই সীতার রূপের বর্ণনা দেন। পরে রাবণের আরেক মন্ত্রী মহোদরও রাবণের কামকে প্রলুব্ধ করে বলেন, “রাজা কামরূপী পুরুষার্থকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন, কর্ম দিয়েই কামনা পূর্ন হয়। আমরাও তাঁর মতকে সমর্থন করি, ….. কামই শ্রেষ্ঠ। জীবনের উদ্দেশ্য সুখভোগ, কামই কর্মের লক্ষ্য”। (১৬)
সীতাহরণের সময় অমিত বীর রাবণ কিন্তু তাঁর বীরত্বের পরিচয় দেন নি, তিনি আশ্রয়
নিয়েছিলেন ছলনার। আসলে শ্রীরামের বীরত্বের কথা (জনস্থানের যুদ্ধে খর -দূষনকে সৈন্যসহ একাহাতে হত্যা করা) রাবণ শুনেছিলেন অকম্পনের নিকট। তাই হয়তো সম্মুখ সমর তিনি এড়াতে চেয়েছিলেন। যাইহোক রাবণ সীতার কাছে আসেন পরিব্রাজক রূপ ধরে। (১৭) সীতার রূপে যে কামুক রাবণ উত্তেজিত হন, তা বোঝা যায় বাল্মীকির শ্লোক পড়লে।
“ *সমা: শিখেরিন: স্নিগ্ধ পান্ডুরা দশনাস্তব।
বিশালে বিমলে নেত্রে রক্তান্তে কৃষ্ণতারকে।।
বিশালাং সঘনং পীনমূরূ কারকরোপমৌ।
এরাবু পচিতৌ বৃত্তৌ সংহতো সংপ্রগলভিতৌ।।
পীনোন্নতমুখৌ কান্তৌ স্নিগ্ধতা লফলমৌ।
মনিপ্রবেকাভরনৌ রূচিরৌ তৌ পয়েধরৌ।।”*
অরণ্য । ৪৬ । ১৮ – ২০ ।
[ তোমার দশনরাজি সমান, সুগঠিত, চিক্কন ও শুভ্র। নেত্র নির্মল ও আয়ত। অপাঙ্গ রক্তাভ, তারকা কৃষ্ণবন। নিতম্ব বিশাল ও স্থূল। ঊরুদ্বয় হস্তিশুন্ডের ন্যায়। তোমার ঐ উচ্চ বর্তুল দৃঢ় ও লোভজনক স্তনযুগল উত্তম, মনিময় আভরনে ভূষিত। তাদের মুখ পীনোন্নত, গঠন স্নিগ্ধ তাল ফলের তুল্য সুন্দর। ]
সীতাকে রাবণ তাঁর পরিচয় দিয়ে, তাঁর বৈভব বর্ণনা করে তাঁকে প্রধানা মহিষী করার প্রলোভন দেখান, কিন্তু সীতা রাবণকে নীচ, ধূর্ত, মিথ্যাবাদী বলেন। কারন শ্রীরামের সঙ্গে
যুদ্ধের সাহস তাঁর ছিল না। তাই সন্ন্যাসীর বেশে তিনি সীতাহরণ করতে আসেন। (১৮) অটল, অবিচল সীতা রাবণকে তাঁর নিষ্ঠুরতা আর ইন্দ্রিয়াসক্তির জন্য তিরস্কারও করেন। শেষে রাবণ নিজমূর্তি ধারণ করে সীতাকে কোলে বসিয়ে (বলপূর্বক) পুষ্পক বিমানে উঠে পড়েন। সীতা উন্মত্তের মত বিলাপ করতে থাকেন।
অনেক সমালোচক মনে করেন রাবণ যেহেতু সীতাকে বলপূর্বক পত্নী বানান নি, তাই তিনি সংযমী পুরুষ। এই ধারণা অত্যন্ত হাস্যকর। রাবণ সীতার গায়ে হাত দেন নি তার প্রথম কারন হল সীতার তেজ ও আত্মবিশ্বাস। রাবণের প্রাসাদে বন্দী দেব, গন্ধর্ব কন্যাগণ , অন্যান্য ভার্যাগন সীতার তেজস্বিতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবে ও ভঙ্গিতে সীতাকে আশ্বাস দিয়েছেন। (১৯) এছাড়াও রাবণের মাতা, রাণী মন্দোদরী, মন্ত্রী ও মাতামহের ভ্রাতা মাল্যবান, ভাই বিভীষণ ও কুম্ভকর্ণ, প্রধান মন্ত্রী অবিন্দ্ধ্য রাবণকে সীতাকে মুক্ত করার সুপরামর্শ দেন এবং এনাদের অতিক্রম করে সীতাকে সম্ভোগ করার সাহস রাবণের ছিল না। এছাড়াও রাবণের মাথায় ছিল নলকুবেরের অভিশাপ। রম্ভাকে ধর্ষনের জন্য তিনি রাবণকে অভিশাপ দেন যে বলপূর্বক কোন নারীকে ভোগ করলে রাবণের মাথা সাতটুকরো হয়ে যাবে। (২০) তবে সীতাকে পাবার আশা রাবণ কিন্তু ছাড়েন নি। তিনি রাষ্ট্রহিত ভুলে গিয়ে সভাসদদের বোঝান সীতা একবছর সময় চেয়েছেন। আবার যুদ্ধের পূর্বে মায়াবী রাক্ষস বিদ্যুজ্জিহ্বের সাহায্যে সীতার সম্মুখে শ্রীরামের মায়ামুন্ড উপস্থিত করেন। উদ্দেশ্য শ্রীরামের মৃত্যু হলে সীতা রাবণকে পতিরূপে বরণ করতে পারবেন। কিন্তু সীতার মন তাতেও রাবণের প্রতি সদয় হয় নি ( যুদ্ধকান্ড, সর্গ ৩১ – ৩২ )। মেঘনাদের মৃত্যুর পর রাবণ সীতাকে হত্যা করতে যান ( যুদ্ধকান্ড, সর্গ ৯১ – ৯৩ )। সে যাত্রায় রাবণের অমাত্য সুপার্শ্ব রাবণকে বুঝিয়ে সীতা হত্যা থেকে বিরত করেন।
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড : সর্গ নং: শ্লোক নং
১৬. সুন্দরকান্ড : ৬৪: ৭ – ১০
১৭. অরন্যকান্ড: সর্গ :৪৬ – ৪৯।
১৮. অরন্যকান্ড : ৫৩ :৩-৪, ৬-৭, ৯
১৯. সুন্দরকান্ড :২২ :১০ – ১১
২০. উত্তরকান্ড: সর্গ ২৬
💐💐💐
অভিশপ্ত রাবণ:
রামায়ণে দেখা যায় যে রাবণ বহু মানুষের ক্ষতি করেন এবং সারাজীবনে অনেকের অভিশাপে অভিশপ্ত হন। ঋষি ও দেবকন্যারা যাঁদের তিনি হরণ করেন, তাঁরা রাবণকে অভিশাপ দেন যে কোন এক অপহৃতা নারীর জন্যই রাবণের মৃত্যু হবে। সাধিকা বেদবতী, রম্ভার প্রেমিক নলকুবের, ইক্ষাকু বংশীয় রাজা অনরণ্য , শিবের অনুচর নন্দী ( এনাকে বানরের মত মুখ বলে রাবণ ব্যাঙ্গ করেন ) রাবণকে অভিশম্পাত করেন। (২১) এতজনের অভিশাপ কুড়িয়ে কেউ ভাল হতে পারেন কিনা জানা নেই। মহাদেবও দেবগণকে প্রতিশ্রুতি দেন যে রাক্ষসগনের বিনাশকারিনী কোন নারীর আবির্ভাব হবে। (২২)
তথ্যপঞ্জী:
কান্ড : সর্গ নং :শ্লোক নং
২১. উত্তরকান্ড: ১৬: ১৭ – ২০
২২. যুদ্ধকান্ড : ৯৫ :৩৬
পরিশেষে বলা যায় যে রাবণ বীর, সম্পদশালী, পন্ডিত, কিন্তু অহংকারী কামুক ও নিষ্ঠুর শাসক। অনেকে রাবণের স্বর্ণলঙ্কা দেখে রাবণকে খুব ভাল শাসক হিসাবে তুলে ধরতে চান। ভাবখানা এমন যে তিনি দেশকে পরম বৈভবশালী করে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি এমনই এক শাসক যিনি নিজের দম্ভ, জেদ আর কামের যূপকাষ্ঠে নিজের সৈন্যদের, আত্মীয়দের এমনকি পুত্রদেরও বলি দেন। শ্রীরাম সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য লঙ্কা আসেন নি। সীতাকে মুক্তি দিলেই যুদ্ধ এড়ানো যেত, কিন্তু রাবণ সীতাকে পাবার আশা ছাড়বেন না। তাই তিনি দেশপ্রেমের জিগির তুলে তাঁর সৈন্যদের দেশরক্ষার জন্য শ্রীরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনুপ্প্রাণিত করেন। কিন্তু আসলে রাক্ষস বীরগণ যুদ্ধ করেন তাঁদের রাজার দম্ভ ও কামের পক্ষে, তাই তাঁরা পরাজিত হন। আধুনিক কালে আমাদের রাবণের কথা জানা উচিত একারনেই যাতে আমরা অহংকারের বশে, আসুরিক ভোগের তাড়নায়, আমাদের বুদ্ধি ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার না করি, আমরা যাতে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝে সংযত, ধৈর্যশীল এবং বিনয়ী হয়ে চলি।
তথ্যসূত্র:
১) বাল্মীকি রামায়ণ সারানুবাদ : রাজশেখর বসু
এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স লিমিটেড : ১৪২০ [ ইং 2013 ]
ISBN 978-81-7157-129-1
২) ‘রাবণ’ : রামায়ণ কথা : স্বামী তথাগতনন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, May 2007
লেখক : সূর্য শেখর হালদার