
রেজাউল মানিক
ভারতবর্ষে অত্যাচারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম হিন্দু বিদ্রোহীগন মনে হয় ঠগী সম্প্রদায়। এরা মূলত ছিলেন হিন্দু কৃষক শ্রেণীর। মুসলমান শাসকদের চাপানো জিজিয়া, খুমস, নজরে নিকা, নজরে বেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন করের বোঝায় অতিষ্ঠ হয়ে এবং পরিবারের নারী শিশুদের সম্ভ্রম হারিয়ে পেটের দায়ে এই হতভাগ্য হিন্দুরা হয়ে ওঠেন খুনে ডাকাত। মুসলমান সৈনিক এবং মুসলমান ব্যবসায়ী এঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও, পরবর্তী কালে এঁরা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে হিন্দু ও মুসলমান উভয়কেই আক্রমণ করতেন। মুসলমান ছাড়াও মুসলমানদের দালালি করা হিন্দুরাও ছিলেন এঁদের টার্গেট। এঁরা ছিলেন মা কালির উপাসক। গভীর জঙ্গলে মা কালির পূজা করা এবং ফল মূল খেয়ে জীবন ধারণ করাই ছিল এঁদের জীবন। ঠগ একটি সংস্কৃত শব্দ যা থেকে ঠগী শব্দটি উদ্ভূত। শাব্দিকভাবে এর অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। বাংলা অভিধানে ঠগী বলতে বিশেষ শ্রেণীর এক দস্যু দলকে বোঝায় যারা পথিকের গলায় রুমাল বা, কাপড় জড়িয়ে হত্যা করেন। ঠগীরা ছিলেন ভারতবর্ষের মুসলমানদের সুযোগ পেলেই খুন করার খুনী সম্প্রদায়। এঁদের মতন নিষ্ঠুর আর নিপুণ মুসলমান খুনীর দল পৃথিবীতে শুধু নয়, ইতিহাসেই বিরল।
ঠগীরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে মুসলমানদের মধ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তাঁরা যত মুসলমান হত্যা করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। কেবল ১৮৩০ সালেই ঠগীরা প্রায় ৩০,০০০ জন মুসলমানকে হত্যা করেছেন।
১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে ঠগীদের কথা প্রথম জানা যায়। এই ঠগী শ্রেণীর মানুষেরা উত্তর ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর বহু শতাব্দী ধরে বংশ পরম্পরায় তাদের এই কর্মকান্ড চালাতে থাকে। এঁরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন, পথে মুসলমান যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন। তারপর সময় সুযোগ বুঝে যাত্রীদের মেরে ফেলে সবকিছু লুট করতেন। ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের মুসলমান পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম এই ঠগী। কিন্তু বাংলায় তাঁদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ফিরোজ শাহর ইতিহাস গ্রন্থ হতে জানা যায়, ১২৯০ এর সুলতানী শাসনের সময় প্রায় হাজার খানেক ঠগী ধরা পরে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম সাজা না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সাথে নৌকায় তুলে দিয়ে ভাটির দেশে- তথা এই বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পরে এই খুনির দল। বাংলায় ঠগীদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই। শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত মুসলমান পথিক। কোথায়, কীভাবে হারাতো, জানত না কেউ। কোনো এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে। কত মুসলমান এবং মুসলমানদের দালালি করা হিন্দু হারিয়েছিল এভাবে? গিনেস বুকের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ লক্ষ! নিরীহ পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে তাদের মালামাল লুট করত যারা- ভারতীয় কিংবদন্তীতে আমরা তাদের ঠগী বলে চিনি। সেই ঠগী, যারা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম খুনিদের মধ্যে অন্যতম বলে চিহ্নিত। ঠগীরা ছিলেন ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথম দিকে ভারতের মুসলমান পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।
ঠগীরা সবসময় চলতেন দল বেঁধে। তাঁরা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা মুসলমান সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করতেন। এঁদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করতেন। তারপর যাত্রীদের সংগে মিশে যেতেন। যাত্রা বিরতিতে যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতেন। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, গরম খাবার খেয়ে পথ চলতি ক্লান্ত যাত্রীরা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে থাকেন। আর তখনেই আসতো সর্দারের হুকুম। সর্দারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাত্রীদের ওপর ঘটতো নির্মম হত্যাকাণ্ড। একজন যাত্রীকে খুন করতেন তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ধরে রাখতেন, অন্যজন ফাঁস পরাতেন, আরেকজন পা চেপে ফেলে দিতেন। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, ঠগীদের অন্য দলটি কাছেপিঠেই ওঁত পেতে থাকতেন।
এই ঠগীরা নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করতেন। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক সাঙেতকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিতেন। ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়। যে কোনো সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতোই এরূপ নিজস্ব নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় ঠগীরা নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করত। গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।
বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের সদস্যদের খুবই নির্দিষ্ট সব দায়িত্ব ছিল। সর্বাগ্রে থাকতো ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সাথে ভাব জমানোর ও শিকার সম্পর্কে নানা তথ্য যোগাড়ের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর। পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদেরকে বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকত। নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকত ‘নিসার’দের উপর।
কবর তৈরি করারে দায়িত্ব যার তাকে বলা হতো ‘বিয়াল’। শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’। আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’দের। পরবর্তীতে ইংরেজরা এঁদের শেষ করে না ফেললে এঁরাই পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে নির্বিচারে হিন্দুদের হত্যা এবং হিন্দু নারী শিশুদের ধর্ষণ রোধ করতে পারতেন। সময়ের দাবিতে হিন্দুদের নিরাপত্তায় আবারও পশ্চিম বাংলার মাটিতে সেই ঠগী সম্প্রদায়ের আর্বিভাব হওয়া খুবই স্বাভাবিক।