
উইল ডুরান্ট
(দ্বিতীয় পর্ব )
এক বিরাট চোরের এই সাফল্য তার মৃত্যুর পর সাধারণের চোখে তাকে মহানতা প্রদান করেছিল। তা দেখে অপরাপর মুসলিম শাসকেরা অনুপ্রাণিত হয়ে লাভবান হয়েছিল বটে, কিন্তু মামুদের চেয়ে অধিকতর সাফল্য আর কেউ অর্জন করেনি। ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের তুর্কি উপজাতির ঘুরি( বা ঘোরী ) ভারত আক্রমণ করে দিল্লী দখল করে মন্দিরগুলি ধ্বংস করেন। বাজেয়াপ্ত করেন মন্দিরে থাকা সকল ধন-রত্ন। দিল্লীতে তাদের সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রাসাদ স্থাপন করেন। শুরু হলো বিদেশী স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা। সমগ্র উত্তর ভারত তিন দশক ধরে শাসিত থাকার পর তার অবসান হয় গুপ্তহত্যা ও বিদ্রোহের মাধ্যমে। প্রথম রক্তস্নাত সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবক- নির্দয়, ধর্মোন্মাদ এবং নিষ্ঠূর বলে খ্যাত। মুসলিম ঐতিহাসিকদের কথায়, ”কুতুবদ্দিনের দানে অনুগৃহীতদের সংখ্যা যেমন লক্ষাধিক, তেমনি হত্যার সংখ্যাও শত সহস্র। এই যুদ্ধবাজ এক যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজার ব্যক্তিকে ক্রীতদাস করেন, নিজেও ছিলেন মহম্মদ ঘোরীর ক্রীতদাস এবং হিন্দুদের রক্তে যুদ্ধক্ষেত্রও হয়ে ওঠে রক্তের বন্যায় কর্দমাক্ত।’ ওপর এক সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন বিদ্রোহীদের দমন করতেন হাতির পদদলনে দলিত করে অথবা তাদের ছাল ছাড়িয়ে খড় ভর্তি করে দিল্লী দরওয়াজায় ঝুলিয়ে দিয়ে। যখন দিল্লীতে বসবাসকারী কিছু মোগল ইসলাম গ্রহণ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তখন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি (চিতোর বিজেতা) সমস্ত পুরুষদের(সংখ্যা পনেরো থেকে ত্রিশ হাজার ) এক দিনেই হত্যা করেন। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক নিজের পিতাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। পরে তিনি খ্যাতি লাভ করেন এক মহান বিদ্বান এবং লেখক রূপে। গণিত-পদার্থবিদ্যা এবং গ্রীক দর্শনেও তার শখ ছিল। আবার রক্তপাত ও নিষ্ঠূরতাতেও তিনি তাঁর পূর্বসুরীদেরও অতিক্রম করেছিলেন। এই সুলতানেরই এক বিদ্রোহী ভাইপোকে কেটে তার রক্তমাংস ভাইপোর স্ত্রী ও পুত্রকে তিনি খেতে বাধ্য করেন। তাঁরই শাসনকালে মুদ্রাস্ফীতিতে দেশ এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। প্রজারা যতদিন না বনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়, ততদিন অবলীলায় তাদের হত্যা করে রাজ্যজুড়ে মৃতের পাহাড় ইনিই গড়ে তোলেন। তিনি এতো হিন্দুকে হত্যা করেন যে, মুসলিম ঐতিহাসিকরা লেখেন -‘তাঁর রাজকীয় তাঁবু এবং বিচারালয়ের সামনে সর্বদা স্তূপীকৃত থাকতো মৃতদেহ। জল্লাদ আর মুদ্দফরাসেরা মৃতদেহগুলি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। আম জনতার সামনে হত্যাকান্ড চলতো অবিরাম।’ দৌলতাবাদে নূতন রাজধানী করে সমস্ত দিল্লীকে মরুভুমি করে সমস্ত দিল্লীবাসীকে সেখানে যেতে বাধ্য করা হয়। সুলতান যখন শুনলেন যে, একজন অন্ধ দিল্লীতে রয়ে গিয়েছে, তখন হুকুম দিলেন, তাকে যেন নূতন রাজধানীতে টানতে টানতে নিয়ে আসা হয়। আদেশ পালিত হলে দেখা গেলো অন্ধের একটি পা এসে পৌঁছেছে।’ সুলতানের অভিযোগ ছিল, প্রজারা তাকে ভালোবাসে না, এবং তাঁর ন্যায়বিচারকে মান্যতা দেয় না। এই শাসক সিকি শতাব্দী রাজত্ব করেন এবং শয্যাগত হয়ে মারা যান। তাঁর উত্তরাধিকারী ফিরোজ শাহ বাংলা আক্রমণ করেন। তিনি প্রতিটি হিন্দুর মাথা কাটা পিছু পুরস্কার ঘোষণা করেন। তাতে ১, ৮০,০০০ হিন্দুর মাথা কাটা পড়ে। প্রতিটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম থেকে ক্রীতদাস সংগ্রহ করা হতো। তিনি ৮০ বছর বয়সে মারা যান। সুলতান আহমেদ শাহ তাঁর রাজত্বে প্রতিরোধবিহীন হিন্দুদের হত্যা করতেন। সংখ্যা যেদিন বিশ হাজার অতিক্রম করতো, সেদিন থেকে চলতো তাঁর বিশেষ ভোজ পর্ব।
এই সকল শাসকেরা অধিকাংশই ছিলেন কুশল এবং দক্ষ। তাঁদের অনুগামীরা ছিল ভয়ঙ্কর রকমের সাহসী ও অধ্যবসায়ী। এই গুণগুলি ছিল বলেই আমরা বুঝতে পারি চারিদিকে এতো সকল বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী থাকা সত্বেও মুষ্টিমেয় শাসকশক্তি কি করে এতদিন টিকে ছিল। তাঁরা সকলেই ছিলেন এমন এক ধর্মের অস্ত্রের অস্ত্রে সজ্জিত, যেটি কার্যক্ষেত্রে সামরিক ভাবাপন্ন। আবার, তৎকালীন ভারতের জনপ্রিয় ধর্মমতগুলির তুলনায় তাঁদের সুখ-দুঃখ নিস্পৃহ একেশ্ববাদী ধর্মমত ছিল অনেক অনেকখানি এগিয়ে। তাঁরা স্বীয় ধর্মমতের আকর্ষণকে গোপন রাখতেন। হিন্দু ধর্মমতের প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে হিন্দুদের আরও বেশি করে আত্মানুসন্ধানের পথে ঠেলে দেন। এই বুভুক্ষু স্বৈরাচারী শাসকদের মধ্যে যোগ্যতা ও নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল, তাঁরা শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, কারিগর ও কলাবিদ- যার অধিকাংশই হিন্দু বংশজ, তাদের নিয়োগ করতেন বড়ো বড়ো মসজিদ এবং মকবরা নির্মাণের কাজে। শাসকদের মধ্যে পন্ডিত এবং বিদগ্ধজনও ছিলেন, যাঁরা বিজ্ঞানী, কবি এবং ঐতিহাসিকদের সাথে আলোচনা করে তৃপ্ত হতেন। এশিয়ার অন্যতম প্রখ্যাত জ্ঞানী, পন্ডিত আলবেরুনী গজনীর মামুদের সাথে ভারতে এসেছিলেন, যিনি ভারতের উপর এক বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যার সাথে তুলনা করা চলে প্রিনির ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ এবং হামবোল্টের ‘কসমস’। মুসলিম ঐতিহাসিকদের সংখ্যা খুবই কম ছিল, তবে তাঁরা যুদ্ধ বা রক্তের হোলি খেলায় নিজেদের জড়াতেন না।
সুলতানেরা রাজস্বের প্রতিটি টাকা বলপূর্বক আদায় করে ছাড়তেন আর সেইসঙ্গে চলতো সোজাসুজি ডাকাতি। তবে সুলতানেরা ভারতেই থাকতেন, তাদের অর্জিত লুন্ঠন সম্পদ ভারতেই ব্যয় হতো অর্থাৎ পরোক্ষে তা ভারতের আর্থিক জীবনেরই অঙ্গীভূত থাকতো। তথাপি শাসকদের শোষণ ও নিপীড়ন যত বেশি চলেছে ততই হিন্দুদের স্বাস্থ্য, মনোবল ও শৃঙ্খলা দুর্বলতর হতে থাকে।
সুলতানদের পদ্ধতিগুলো আলাউদ্দিন খিলজির কার্যাবলী থেকে ভালোভাবে বোঝা যায়। তিনি তাঁর পরামর্শদাতাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন, ”হিন্দুদেরকে পিষে ফেলার এবং সমস্ত সম্পত্তি ও সম্পদ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার নিয়ম-কানুনগুলিকে সুসংবদ্ধ রূপ দিতে, কারণ এই সম্পদ ও সম্পত্তিই তাদের অসন্তোষ ও বিদ্রোহের বীজ। তাই তাদের অবদমিত করার জন্য নিয়ম কর। ” জমির ফসল থেকে আসা আয়ের অর্ধেক সরাসরি সরকার পাবে, দেশীয় শাসকেরা নিতেন এক-ষষ্ঠাংশ। এক মুসলিম ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘কোনও হিন্দু মাথা উঁচু করে(সদর্পে) চলতে পারে না এবং তাদের ঘরে কোথাও সোনা-রুপোর চিহ্ন থাকে না …. অথবা আনন্দ ও প্রাচুর্য দেখা যায় না। রাজস্ব আদায়ের জন্য করা প্রহার, বন্দী, শেকল পরানো, কারাগার -সব কিছুরই প্রয়োগ চলতো। যখন আলাউদ্দিনের একজন বিদ্বান পরামর্শদাতা এই কঠোর নিয়ম-নীতির প্রতিবাদ করেন, তখন আলাউদ্দিন প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ও জ্ঞানী ব্যক্তি, আপনি এত বিদ্বান, কিন্তু আপনার বাস্তব জ্ঞান নেই; আমি নিরক্ষর তবে যথেষ্ট বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী। আপনি নিশ্চিত জানুন যে হিন্দুরা দরিদ্র না হলে তারা কখনও অবনত এবং অনুগত থাকবে না। তাই আমি আদেশ দিয়েছি, তাদেরকে যতটা প্রয়োজন ততটা শস্য, দুধ এবং দই বছরে দিতে, কিন্তু তারা সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না।”
এটিই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুপ্ত তথ্য। অভ্যন্তরীণ বিভেদের ফলে এরা দুর্বল হয়ে বিদেশী আক্রমণকারীদের কাছে নতিস্বীকার করেছে, হামলাকারীদের অবাধ লুটের ফলে এরা দরিদ্র ও ক্ষীণ হয়েছে। সমস্ত প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলে দৈবশক্তির আশ্রয় নিয়েছে ; অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছে যে, দাসত্ব ও প্রভুত্ব- দুটোই ভ্রান্তিমাত্র; এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে ব্যক্তি ও জাতির স্বাধীনতা এমনকিছু বড়ো ব্যাপার নয় যা রক্ষা করতে এই ক্ষণস্থায়ী মনুষ্যজীবনকে কাজে লাগাতে হবে। এক সমুন্নত সভ্যতার এই বিয়োগান্তক কাহিনীর তিক্ত শিক্ষা হলো এই যে, চিরন্তন সতর্কতাই সভ্যতার মূল্য। একটা জাতি অবশ্যই শান্তিকে ভালোবাসবে, কিন্তু সর্বদাই তার বারুদকে তাজা রাখতে হবে। -(পৃষ্ঠা ৪৫৯-৪৬৩)
(সমাপ্ত)