
অমিত মালী
এই বাংলায় এখন হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণবদের খুবই বাড়বাড়ন্ত। চারিদিকে শুধু ‘জয় রাধে’। আর সময় পেলেই ভোগ-উৎসব। হিন্দুত্ব রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই এদের, কিংবা ধর্মের প্রসার-এর কোনো চিন্তা নেই এদের। তবে এই ভোগ-উৎসবে একটা ব্যাপার খুবই যন্ত্রণাদায়ক- তা হলো এদের ছোঁয়াছুঁয়ি। ভোগের রান্না, পরিবেশন এবং মহাপ্রসাদের বিতরণ সবই এরা নিজেরা করেন। বৈষ্ণব ছাড়া অন্য কোনো নিষ্ঠাবান হিন্দু যদি ছুঁয়ে দেন, তাহলে সর্বনাশ। তাহলে আপনি বিশাল অন্যায় কাজ করে ফেলবেন। আর আপনি যদি ভক্তিভরে কোনো বৈষ্ণবকে আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন, তাহলে ওই বৈষ্ণব আপনার বাড়ির রান্না করা কোনো কিছুই মুখে তুলবেন না। কারণ কি? কারণ হলো আপনি বৈষ্ণব নন। তাই আপনার সঙ্গে এই ভেদভাব। তাহলে কি দেখছি? মুখে কৃষ্ণের নাম নিয়ে, রাধারাণীর নাম নিয়ে, চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী হয়েও এরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জাত-পাত, উঁচু-নিচু ভেদ এবং একে ঘৃণা-বিদ্বেষকে ব্যাপকভাবে ফিরিয়ে এনেছে। চৈতন্য মহাপ্রভুর সবাইকে কাছে টেনে নেওয়ার শিক্ষা, উচ্চ-নীচ ভেদ না করা- এইসব শিক্ষা এরা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কি এটাই চেয়েছিলেন? কেমন ছিলেন তিনি? কেমন ছিল তাঁর হরেকৃষ্ণ আন্দোলন-যে আন্দোলন পরাভূত হিন্দু সমাজে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল? আসুন একবার ঘুরে আসি কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত পবিত্র গ্রন্থ ”চৈতন্যচরিতামৃত” বইটি ।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই বাংলায় প্রথম কৃষ্ণনাম প্রচার করেন। তিনি এই কৃষ্ণনাম প্রচারকে জন আন্দোলনের রূপ দেন। তিনি কৃষ্ণনাম এবং নগর সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া হিন্দু সমাজে প্রাণ সঞ্চার করেন। আর এর ফলে জাতপাতে দীর্ণ এবং ছোঁয়াছুঁয়ি ও কুসংস্কারে আক্রান্ত হিন্দু সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আর ঠিক এই কারণে হিন্দুদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছিল। আর এই কারণেই মহাপ্রভুর নগর সংকীর্তনকে মুসলমান শাসকরা কখনোই মেনে নেয়নি। তাই বিরোধিতা সত্বেও মহাপ্রভু নগর সংকীর্তন বন্ধ করেননি। কারণ তিনি কাপুরুষ ছিলেন না। বাংলায় তখন ইসলামিক শাসন। শাসক হিসেবে আছেন হুসেন শাহ। ইসলামিক শাসনের চাপে এবং গোঁড়া ব্রাহ্মণদের ঠেলায় তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। সেইসময় ব্রাহ্মণ সন্তান এবং সংস্কৃতে পন্ডিত শ্রী চৈতন্যদেব ঘোষণা করলেন যে, যাগযজ্ঞ নয়, কৃষ্ণনামই কলিযুগে সর্বশ্রেষ্ঠ। এতে ব্রাহ্মণ সমাজ খুশি না হলেও যখন একের পর এক গ্রাম নগর সংকীর্তনে যোগ দিতে আরম্ভ করলো, তখন ব্রাহ্মণদের আর কিছুই করার ছিল না। এছাড়াও মহাপ্রভু ইসলামে ধর্মান্তরিত অনেককে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনলেন তাঁর কৃষ্ণনামের মাধ্যমে। আর সম্ভবত এই কারণে স্থানীয় মুসলমান সমাজ চটে যায় এবং তাঁরা দলবদ্ধভাবে কাজীর কাছে মহাপ্রভুর বিরুদ্ধে নালিশ করে –
“মৃদঙ্গ করতাল সংকীর্তন মহাধ্বনি। হরি হরি বিনা অন্য নাহি শুনি।। শুনিয়া সে ক্রূদ্ধ হইলো সকল যবন। কাজী পাশে আসি সব কৈল নিবেদন”।। (আদিলীলা, চৈতন্যচরিতামৃত )
এতে চাঁদকাজী(মতান্তরে চাঁদ মহম্মদ) রেগে যান এবং মুসলমান সেনা পাঠিয়ে সংকীর্তনের মৃদঙ্গ, খোল-করতাল ভেঙে দেন। সেইসঙ্গে চাঁদকাজী হুমকি দেন যে আর কেউ যেন কৃষ্ণনাম না করে। আর কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করে কৃষ্ণনাম করে , তবে তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নেবার হুমকি দেন চাঁদ কাজী, এমনকি তাঁর ধর্মও –আর যদি কীর্তন করিতে লাগ পাইনু। সর্বস্ব দন্ডিয়া তাঁর জাতি সে লইমু।। মুসলমান শাসকের এই অন্যায় এবং হিন্দুর ধর্মাচরণে বাধা-এটাকে মহাপ্রভু কখনোই বর্তমানের মোটা চামড়ার বৈষ্ণবদের মতো মেনে নেননি। তিনি নবদ্বীপের আশেপাশের অনেকগুলি গ্রামের হিন্দুদের, যেমন- পারডাঙ্গা, গাদিগাছা ইত্যাদি গ্রামের হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং নগর সংকীর্তন করার নির্দেশ দেন। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই যে আশেপাশের গ্রামের হিন্দুদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা-এই ঘটনা মহাপ্রভুর সংগঠক শক্তির পরিচয় দেয়। মহাপ্রভু বলেন যে তিনি নিজে মিছিলের সামনে থাকবেন। নির্দিষ্ট দিনে শ্রী চৈতন্যদেব সবাইকে কীর্তন করার আদেশ দিলেন এবং তিনি সংকল্প নিলেন যে আজ সব যবন অর্থাৎ মুসলমানদেরকে সংহার করবেন :-
প্রভু আজ্ঞা দিল যাহ করহ কীর্তন। মুই সংহারিমু আজি সকল যবন।। নগর সংকীর্তন এগোতে লাগলো বিশাল সংখ্যক হিন্দুসহ। এই অবস্থায় মুসলমান কাজী ভয় পেয়ে বাড়ির কোনো একস্থানে লুকিয়ে পড়েন – কীর্তনের ধ্বনিতে কাজী লুকাইলো ঘরে। তর্জন গর্জন শুনি না আসে বাহিরে ।। ক্ষিপ্ত হিন্দুরা কাজীর ফুলের বাগান, ঘরদোর ভাঙচুর করেন। পরে মহাপ্রভু নিজে কাজীকে ঘর থেকে বের করে আনেন এবং দুজনের মধ্যে তুমুল যুক্তি-তর্ক শুরু হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু চাঁদকাজীকে গোহত্যা বন্ধ করার আদেশ দেন এবং বলেন যারা গোহত্যা করে, তারা লক্ষকোটি বছর ‘রৌরব’ নামক নরকে কাটায় – “প্রভু কহে বেদে গোবধ নিষেধ। অতএব হিন্দু মাত্র না করে গোবধ ।। জিয়াইতে পারে যদি তবে মারে প্রাণী। বেদ পুরাণে আছে হেন আজ্ঞা বাণী” ।। যুক্তিতর্কে চাঁদকাজী পরাজিত হন- ”বিচারিয়া কহে কাজী পরাভব মানি”। এছাড়াও চৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অনেক মন্দির ও তীর্থস্থানগুলি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চৈতন্যদেবের গুরু মাধবেন্দ্রপুরী বৃন্দাবনে গোপাল মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন। আর এক শিষ্য সনাতন গোস্বামী, যাকে হুসেন শাহ বন্দি করেছিলেন, তিনি মথুরায় অনেকগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও মূর্তি উদ্ধার করেন।
কিন্তু এরকম একজন ব্যক্তির শেষ জীবন যথেষ্ট রহস্যময়। আর এক্ষেত্রে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থেও কোনো সমাধানসূত্র নেই। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ অনুযায়ী মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করেন কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে। এরপরে তিনি আর কখনও নবদ্বীপে ফেরেননি। তিনি অদ্বৈত আচার্যের গৃহে কিছুকাল থাকার উদ্দেশ্যে শান্তিপুরে যান। কিন্তু কেন মহাপ্রভুকে নবদ্বীপ ত্যাগ করতে হলো? কারণ মুসলমান শাসক হুসেন শাহ এবং মহাপ্রভুর বিরোধ। এর ফলেই মহাপ্রভু নবদ্বীপ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু রাজ্য উড়িষ্যায়। উড়িষ্যার রাজা গজপতি প্রতাপরুদ্র এবং তাঁর সভাপন্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য ছিলেন মহাপ্রভুর ভক্ত। কিন্তু হুসেন শাহ হাল ছাড়েননি। তিনি মহাপ্রভুর শিষ্য সনাতন গোস্বামীকে বন্দি করেন এবং উড়িষ্যা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সনাতন গোস্বামী কারারক্ষীকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁর উড়িষ্যা আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে মুসলমান শাসকের চক্রান্তে মহাপ্রভুকে হত্যা করা হয়েছিল, একথা কদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ ভারত ভ্রমণ সম্পূর্ণ করার পর মহাপ্রভু পুরীতে ফিরে আসেন এবং জীবনের শেষ আঠারো বছর তিনি পুরীতেই ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন কাশীশ্বর মিশ্রের আশ্রম গম্ভীরাতে। আর একটি অনুমান ছিল যে পান্ডারা মহাপ্রভুকে হত্যা করে মন্দিরের মধ্যেই কোনো স্থানে অথবা তাঁর দেহ দেওয়ালে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ও একই মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর প্রমানও পাওয়া যায়। কারণ ২০০০ সালে পুরীর মন্দির সংস্কারের সময় মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে একটি মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছিল। সেই কঙ্কালের দৈর্ঘ ছিল ছয় ফুট দুই ইঞ্চি। এতে অনেকের ধারণা পোক্ত হয় যে চৈতন্যদেবকে পুরীর মন্দিরেই গুমখুন করা হয়েছিল। আর সেই গুমখুনের ঘটনা চাপা দিতে প্রচার করা হয় যে মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের দেহে লীন হয়ে গিয়েছেন। তবে যেভাবে মৃত্যু হোক না কেন, ইসলামিক শাসনকালে হিন্দুত্বের প্রচার করা, ধর্মাচরণের বাধা দেবার প্রতিবাদ করার সাহস একমাত্র মহাপ্রভু দেখিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে হিন্দু সমাজের মধ্যে সাহসের সঞ্চার ঘটিয়েছিল তাঁর হরেকৃষ্ণ আন্দোলন। তাই সব দিক থেকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য মহানায়ক ছিলেন, যিনি হিন্দু সমাজকে ধর্মরক্ষা এবং প্রসারের নতুন পথ দেখিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ- চৈতন্যচরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ।